SaiF UddiN

https://assets.roar.media/assets/wzOQTd7mVaTHTce5_IMG_4434.JPG

সকাল ছয়টা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। দেশের সর্বউত্তরের একেবারে শেষ সীমা বাংলাবান্ধার স্থল বন্দরের গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। কনকনে ঠাণ্ডা। একেবারে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে প্রকৃতি। সামনে বেশিদূর দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার কারণে। টানা প্রায় ১৩ ঘণ্টা যাত্রা করে এসে শরীর সায় দিচ্ছে না, কিন্তু প্রকৃতি যেন নিশাচর সমুদ্রের ন্যায় আরো কাছে টানছে। 
দূরে দেখলাম, ভারতের সীমানার পাশ দিয়েই একটি আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। কেউ সাইকেলে কিংবা কেউ হেঁটে হেঁটেই এই শীতের সকালে কাজে যাচ্ছে।

বাংলাবান্ধার ভোরের সৌন্দর্য; © Writer
সীমানা ঘেঁষা গ্রাম্য রাস্তায় এক ভারতীয় নাগরিক; Photo © Writer

এসবের ছবি তুলে ঘুরে তাকিয়ে দেখি আমার গ্রুপের সবাই বাংলাবান্ধার তথা বাংলাদেশের শেষ সীমানা হিসেবে স্থাপিত এক বিশাল জিরো বা ‘শূন্য’র সামনে দাঁড়িয়ে। ঠিক তার ডান পাশেই ভারতের সীমানা গেট দেখা যাচ্ছে। শেষমেশ আমরা বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের সীমানার নো ম্যান্স ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে।
হ্যাঁ, ঘুরে এলাম হিমালয়কন্যা খ্যাত দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড় থেকে। ঢাকা থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৪ই ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে পাঁচটায় এবং শেষ হয়েছিল ১৫ই ডিসেম্বর সকাল প্রায় সাড়ে ছয়টায়। সেদিন সারাদিন পঞ্চগড়ের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখে রাতে থাকার জন্য চলে গিয়েছিলাম ঠাকুরগাঁওয়ের আরডিআরএস গেস্ট হাউজে। সেদিন সন্ধ্যাটা ঠাকুরগাঁও জেলা শহরটা ঘুরে দেখেছিলাম। রাতে থেকে সকালে উঠেই চলে গিয়েছিলাম দিনাজপুরে। কম সময়ের মধ্যে যতটা ঘুরে দেখা যায় দেখে আবার ঠাকুরগাঁও ফিরে বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে করে ঢাকায়। এই পুরো ভ্রমণ বৃত্তান্তের দুই পর্বের প্রথম পর্বে আজকে থাকছে পঞ্চগড়ের ভ্রমণ।  

পরিকল্পনা

নভেম্বর মাসের শেষের দিকের একদিনের কথা। নিয়মিত ৩/৪ জনের আড্ডা পরিণত হলো ৯/১০ জনে। কথায় কথায় ঘুরতে যাওয়ার কথা উঠলো। যেহেতু কমবেশি সকলেই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত, তাই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসের আগের দুই দিন মিলিয়ে তিন দিন আর দুই রাতের ট্যুরের পরিকল্পনা করে ফেললাম। কিন্তু যাব কোথায়? সবাই মিলে এই দায়ভার আমার কাঁধেই চাপিয়ে দিল। ২/৩ দিন পর সবাইকে জানালাম, দেশের উত্তরের শেষ সীমানা বাংলাবান্ধা যাওয়া যায়। বলাবাহুল্য, পঞ্চগড়ের কাজী এন্ড কাজী টি স্টেটের কয়েকটা ছবি দেখেছিলাম ফেসবুকের কয়েকটি গ্রুপে। মূলত টি স্টেটের সৌন্দর্য এবং এই সময়টায় নাকি পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজংঘা দেখা যায়। তাই এই জেলাটা পছন্দের তালিকায় ছিল। যেই ভাবনা সেই কাজ, আমরা যাচ্ছি হিমালয়কন্যা খ্যাত পঞ্চগড়।

বাংলাবান্ধার ভোরের সৌন্দর্য; Photo © Writer

যদিও প্রথমে ট্যুরে যাওয়ার জন্যে ১০ জনের সম্মতি ছিল ধীরে ধীরে তা নেমে ছয়জনে পরিণত হলো। ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের সবচাইতে দীর্ঘতম ট্রেন যাত্রা উপভোগ করতে করতে যাবো কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের ৮ দিন আগেও ট্রেনের কোনো টিকেটই পাইনি। যেহেতু ১৬ই ডিসেম্বরের আগে শুক্র আর শনিবার ছিল সরকারি ছুটি, তাই কর্মজীবী সবাই-ই নিজ নিজ পরিবারের কাছে ফিরছিল। টিকেটের খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, শুধুমাত্র হানিফ আর শ্যামলী পরিবহনের একটা করে বাস একেবারে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত যায়। আমাদের পরিকল্পনা ছিল বাংলাবান্ধা থেকে ঘুরতে ঘুরতে পঞ্চগড় আসবো এবং সেখান থেকে বিকেলের মধ্যে ঠাকুরগাঁও গেস্ট হাউজে।

যাত্রারম্ভ

১৪ই ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে চারটার মধ্যে সবাই আড্ডার স্থলে এসে মিলিত হয়। তারপর শ্যামলীতে আমাদের বাসের কাউন্টারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। মূল বাস ছাড়তে দেরি হয় আধা ঘন্টার মতো। এত দূরে আর এতটা সময়ের ব্যাপার। তাই আমরা ভেবেছিলাম, অন্তত বাসের সিটগুলো আরামদায়ক হবে। কিন্তু আমাদের আশায় গুড়েবালি। যা-ই হোক, পাশাপাশি সিট হওয়াতে আলাপ করতে করতেই আমরা শেরপুরে ফুড ভিলেজে থামি সাময়িক বিরতির জন্যে। বিরতি শেষে আমাদের বাসের ড্রাইভার সোহেল ভাই যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। এতটা রাস্তা খুব ধীরেসুস্থে চালিয়ে আসলেও ফুড ভিলেজ থেকে বের হয়েই তিনি সর্বোচ্চ গতিতে বাস চালাতে শুরু করলেন। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন বলতে পারবো না। তবে চোখ খুলেই প্রথমে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি, রাস্তা থেকে খানিকটা দূরেই কমলা বর্ণের লাইট জ্বলে আছে। বুঝতে পারলাম, পঞ্চগড় পেরিয়ে আমরা এখন তেতুলিয়ার কাছাকাছি।

ভারতীয় সীমানা গেট; Photo © Writer

তেঁতুলিয়া বাস স্ট্যান্ডে বাস থামে পাঁচটারও পরে। আমাদের বাসের ড্রাইভার সোহেল ভাই তেঁতুলিয়ার নামকরা খাবারের হোটেল ‘নূরজাহান’ এ আপ্যায়ন করান। বলা বাহুল্য, আমাদের টিকেটে বিশেষ কিছু লেখা ছিল, যার জন্য সাধারণ যাত্রীর চাইতে একটু বেশিই সমাদর পেয়েছি আমরা। সেখান থেকে ড্রাইভার বদলী হয়ে দেলোয়ার ভাই আমাদের বাংলাবান্ধা অবধি নিয়ে যান এবং তিনি নিজে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে স্বল্প সময়ে আর স্বল্প খরচে পঞ্চগড় ঘোরা যাবে।

পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

পঞ্চগড় জেলায় মানব বসতি স্থাপনের সঠিক দিনকালের হিসাব না থাকলেও; ইতিহাস ঘেঁটে বেশ কয়েকটি বিষয় জানা যায়। প্রাচীনকালের ‘পুন্ড্র’ নগরের একটা নগরী ছিল এই পঞ্চগড়, যাকে খুব সম্ভবত ‘পঞ্চনগরী’ ডাকা হত। তবে সবচাইতে বহুল প্রচলিত মত হচ্ছে, পাঁচটি গড়ের অবস্থানের কারণেই একে পঞ্চগড় বলে ডাকা হয়। গড়গুলো হচ্ছে ভিতরগড়, মীরগড়, হোসেনগড়, রাজনগড় এবং দেবেনগড়।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন জনপদ এই পঞ্চগড়। ইতিহাস বলে, এখনকার মতো অতীতেও এই এলাকা সীমান্তবর্তী এলাকা ছিল। পুন্ড্র সাম্রাজ্যই নয়, বরং গুপ্ত, পাল, সেন এবং মুসলিম শাসকগণের আয়ত্তাধীন ছিল এই নগরী। আরো জানা যায়, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন খলজি তিব্বত আক্রমণের সময় এই জনপদ পেরিয়েই গিয়েছিলেন।

পঞ্চগড় জেলার মানচিত্র; Image Source: panchagarh.gov.bd

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল এই পঞ্চগড় থানা। ১৯৮০ সালের পহেলা জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও মহকুমাকে পঞ্চগড় মহকুমা নামে অভিহিত করা হয়। পরবর্তীতে, ১৯৮৪ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড় মহকুমার পাঁচটি থানা তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড় সদর, অটোয়ারী, বোদা এবং দেবীগঞ্জ নিয়ে তিনদিকে ভারতের সীমানা নিয়ে পঞ্চগড় জেলার সৃষ্টি হয়।

দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ

বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট
আমরা যখন বাংলাবান্ধা পৌঁছাই তখন সকাল সাতটার বেশি বাজে। আমরা ছয়জন ছাড়া ঐ মুহুর্তে ঐ এলাকায় কেউই ছিল না। এমনকি কোনো বর্ডার গার্ডও না। বাংলাবান্ধা স্থল বন্দরের সামনে বাংলাদেশের সীমানা শেষের ফলক এবং সেখান থেকেই কয়েক গজ সামনে এগিয়ে বাংলাবান্ধার জিরো পয়েন্ট। আমরা যখন প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি তখন পেছন থেকে বাইকে করে দুজন গার্ডকে আসতে দেখলাম। পরিচয় জেনে নিয়ে আন্তরিকভাবেই জানালেন যে, তাদের উধ্বর্তন কর্মকর্তারা এখনো আসেনি। তারা আসার পর আর কোনো সমস্যা নেই এখানে থাকতে, তবে এখন থাকা যাবে না। অনেকবার বলেও লাভ হলো না, কেননা তিনি শুধুমাত্র তার আদেশ পালন করছেন।

বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট; Photo © Writer

কী আর করা, দূর থেকে জুম লেন্স দিয়ে জিরো এবং ভারতের সীমানা গেটের কয়েকটা ছবি তুলে বাংলাবান্ধা স্থল বন্দরের সামনে চলে এলাম আবার বাসে ওঠার জন্যে। তবে আপনাদের সুবিধার্থে জানিয়ে রাখি, আমরা খুব বেশি সকালেই বাংলাবান্ধা চলে গিয়েছিলাম, যার কারণে আমাদের মিস হয়েছে, তবে আটটা-নয়টার সময় থেকে আর কোনো ধরনের ঝামেলা হয় না। আর যদি বিকাল দিকে, বিশেষ করে আসরের নামাজের পর পর যেতে পারেন, তাহলে দুই দেশের বর্ডার গার্ডদেরই প্যারেড করা অবস্থায় দেখতে পাবেন এবং সেটা উন্মুক্ত সকলের জন্যে। আর সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শনও পেতে পারেন।

কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট: দেশের একমাত্র সমতল ভূমির অর্গানিক চা-বাগান

জিরো পয়েন্টের সাথে সেলফি বা ছবি তুলতে না পারার দুঃখ মনে পুষে নিয়ে বাংলাবান্ধা স্থল বন্দরের সামনের এক চায়ের দোকানে লাল চা পান করলাম। চা শেষে দিনের প্রথম বাসে করে আমরা তিন্নু বাজার চলে গেলাম। সেখানের এক খাবারের হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে নিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা ঠিক করে চলে গেলাম রওশনপুর। বলাবাহুল্য, কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটটা রওশনপুরের ভেতরে। আবার একে স্থানীয়রা আনন্দধারা নামেও চেনে। সদর থেকে গ্রামের ভেতর দিয়ে বেশ কয়েক কিলোমিটার আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে যেতে হয় এই জায়গায়। এখানে যেতে চাইলে তিন্নু বাজার কিংবা যেখান থেকেই যান না কেন, রিজার্ভ অটো নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। নাহয় কয়েক কিলোমিটার হেঁটেও কোনো কিছু পাবেন না। আর অনেক বেশি আঁকাবাঁকা রাস্তা হওয়াতে একবারে মনে রাখাটাও অনেক কষ্টসাধ্য।

সমতল ভূমির অর্গানিক চা বাগান; Photo © Writer

আগেই বলেছি, আমরা এমন একটা সময় বেছে নিয়েছিলাম, যে সময়টায় লোকজন যেমন বাড়ি ফিরছে, তার সাথে সাথে আমাদের মতোও আরো অনেক দল বিভিন্ন জেলা দর্শনে বের হয়েছে। টি এস্টেটের গেটের সামনে নেমেই দেখি দুই দল ভেতরে ঢোকার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ঢুকতে চাইলে রেফারেন্স কিংবা অনুমতি লাগে। ঢাকা থেকে অনুমতি নিয়ে যেতে হয়, নাহয় ভালো রেফারেন্স লাগে, কেননা এটা টি এস্টেটের কার্যালয় এবং মালিকের ব্যক্তিগত বাংলো। তাই দারোয়ানকে টাকা দিয়েও আপনি চাইলেই ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। তবে যদি আন্তরিকভাবে বুঝিয়ে বলেন, তাহলে ভিড় না থাকলে এমনিই ঢুকতে দেয়। যেহেতু ট্যুরের সকল স্পটের দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে, তাই দারোয়ান ভাইকে ডেকে নিজের পরিচয় দিলাম। তিনি জানালেন, ভেতরে অনেক লোক আছে। সবাই ছুটিতে ঘুরতে আসাতে ভিড় হয়ে গেছে। দশটার দিকে যেতে বললেন। ততক্ষণের জন্য চা বাগান ঘুরে দেখার জন্যে বললেন।

চা বাগানের মাঝ দিয়ে চলে গেছে গ্রামের রাস্তা; Photo © Writer

চা বাগানে গিয়ে ছবি তুলে দশটার খানিকটা পর এসে দেখি তখন আরো বেশি লোকজন সেখানে। আর প্রত্যেকেই রেফারেন্স নিয়ে এসেও দাঁড়িয়ে আছে, আর আমরা তো কোনো রেফারেন্সও আনিনি। তাই শঙ্কিত ছিলাম জিরোর মতো এটাও হয়তো বাদ দিতে হবে। কিন্তু দারোয়ান ভাই আমাকে পাশে ডেকে নিয়ে তার স্যারের নাম্বার দিলেন। ফোন দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলাম এবং দারোয়ান ভাইয়ের হাতে একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিলাম তাকে দেখানোর জন্যে। একটু পরই দারোয়ান ভাই এসে ভেতরে নিয়ে গেলেন আমাদের।
ভেতরে ঢুকে যা দেখেছি তাতে এক লাইনে বোঝানোর জন্যে আপাতত একটি লাইনই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, প্রকৃতি আর আধুনিকতা যখন মিশে যায়, তখন এক আদি আর অকৃত্রিম নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সত্যিকার অর্থেই আপনি ভেতরে ঢুকলেই বুঝতে পারবেন কেন এই কথাটা বলেছি। সৌখিনতায় মানুষ কী কী করতে পারে তার এক নিদর্শন হচ্ছে কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটের এই ব্যক্তিগত বাংলো এবং অফিস কার্যালয়ের পুরো জায়গাটি।

গেট দিয়ে ঢুকে হাতের ডানেই এই ইংরেজি এল-আকৃতির ছায়াঘেরা রাস্তাটি চোখে পড়বে; Photo © Writer

দৃষ্টিনন্দন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই হাতের ডান দিকে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে লতাপাতার ছায়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এক প্রবেশপথ। চারিদিকে সবুজের সমারোহে হারিয়ে যখন আপনি সে পথের শেষ প্রান্তে আসবেন, তখন আধুনিক ধাঁচে গড়া কিছু দৃষ্টিনন্দন কটেজ আপনার দৃষ্টি কাড়বে। ভেতরে একটা লেকও আছে, তার পাশেই কয়েকটা কটেজ এবং লেকের ঠিক মাঝেই ব্রিজ পেরিয়ে যাওয়া যায় দৃষ্টিনন্দন বিশ্রামাগারে।

গাছগাছালির ভিড়ে এরকম দৃষ্টিনন্দন কটেজ আপনাকে মুগ্ধ করবে; Photo © Writer

ব্রিজ থেকে শুরু করে হাঁটার রাস্তা, লেক, বিশ্রামাগার, বাংলো, কাঠের কটেজ সবকিছুতেই আভিজাত্য আর নান্দনিকতার স্পষ্ট ছাপ পাবেন। খোলা মাঠে কিছু ঘোড়াকে দেখবেন ঘাস খেতে। ভুলেও সামনে যাবেন না, কেননা এই ঘোড়াগুলোর কামড় দেয়ার বাজে অভ্যাস আছে। আর বের হওয়ার সময় মীনা বাজারে চলে যাবেন। সেখানে আপনি অর্গানিক চা-পাতা এবং অর্গানিক মিষ্টি পাবেন।

এই সৌন্দর্যের ভেতর হারিয়ে গিয়ে কতটা সময় যে পার হয়ে গিয়েছে বলতেই পারবো না। সময়জ্ঞান হিসেবে রাখার কথা, কেননা আমাদের এখনো পুরো পঞ্চগড় ঘুড়ে দেখা বাকি। তাই দেরি না করে দারোয়ান ভাইকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে এলাম। কিন্তু আমরা বোকার মতো যে কাজটা করেছিলাম সেটা হচ্ছে, আমাদের অটো আমরা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই আবার সেই দারোয়ান ভাইয়ের সহায়তায়ই একটা অটো পেয়ে গেলাম। সেটাতে করে তিন্নু বাজার চলে এলাম।
এরকম জায়গা এসে ছবি না তুললেই নয়; Photo © Muhammad Ali Shuvo

তেঁতুলিয়া ডাক বাংলো, মহানন্দা নদী এবং জলপাইগুড়ি ব্রিজ

তিন্নু বাজার নেমে আবার অটো নিলাম তেঁতুলিয়া বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথে আঁখ ক্ষেতে দেখলাম আঁখ কাটা চলছে, আর তখনই দলের সবাই অটো থামিয়ে একজনকে পাঠালো আঁখ চেয়ে নিয়ে আসতে। অটোর চালক নিজে থেকেই নেমে গেলেন যেন আরো খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। প্রায় ৩/৪টা আস্ত আঁখ কেটে কয়েক টুকরো করে আমাদের হাসিমুখেই দিয়ে দিল তারা। কিন্তু আফসোস, এই আঁখগুলো সাধারণত চিনিকলের জন্য করা হয়, তাই এগুলো খুব মিষ্টি হলেও রস একদমই নেই এবং প্রচণ্ড শক্ত। এরপর চলে এলাম তেঁতুলিয়া বাস স্ট্যান্ডে। ভোর বেলা তেঁতুলিয়ার বিখ্যাত তেঁতুল গাছটা ঠিকমত না দেখলেও তখন দেখে নিয়ে আবার হোটেল নূরজাহানে ঢুকে গেলাম হালকা চা-নাস্তা খেতে।
খাওয়া শেষে আমাদের বাসের ড্রাইভার দেলোয়ার ভাইকে ফোন দিলে তিনি এসে একটা অটো ঠিক করে দিলেন। সেটাতে করে প্রথমে গেলাম তেঁতুলিয়া ডাক বাংলো দেখতে। প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো গাছগাছালি পরিবেষ্টিত এই বাংলোটি মনোমুগ্ধকর। পাশেই আছে পিকনিক স্পট। এবং ডাকবাংলোর সামনে একটি জায়গা আছে, যেখানে লেখা- কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার স্পট। সাধারণত দু'দেশের আকাশ পরিষ্কার থাকলে তবেই ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় খুব ভালোভাবেই এই পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়। কিন্তু, আমাদের দুর্ভাগ্য, কেননা আমরা যেদিন পৌঁছেছি সেদিন প্রচুর কুয়াশা ছিল। কয়েকটা ছবি তুলে দ্রুতই চলে গেলাম পুরাতন বাজার।

মহানন্দা নদীতে পাথর উত্তোলনের দৃশ্য; Photo © Writer

পুরাতন বাজার হচ্ছে আগের হাট, যেটা এখন আর নেই। পুরাতন বাজারে অটো থেকে নেমেই প্রথমে চোখে পড়বে সামনে ভারতের সীমানা অতিক্রম করা নিষেধ। একটি প্রাচীন ঘাট আছে, যেটা দিয়ে নীচে নেমে কিংবা সেটার উপর থেকে দাঁড়িয়েই দেখা যায় হাঁটু-সমান মহানন্দা নদীর পানিতে পাথর উত্তোলনের দৃশ্য।
টারশিয়ারী যুগে সমুদ্রের এক প্রলয়ংকারী জলোচ্ছাস এবং প্লাবনে পশ্চিমবঙ্গসহ এ দেশের অনেক অঞ্চলই পানির নীচে তলিয়ে গিয়েছিল। সেজন্যে সমুদ্রজাত পাললিল শিলাস্তর দিয়ে এ দেশের বেশ কিছু অঞ্চল পরিপূর্ণ, যার মধ্যে পঞ্চগড় অন্যতম। তেঁতুলিয়া উপজেলার নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় ৫/৬ ফুট গর্ত করলেই দেখা মেলে পাথর এবং পানিশাল কাঠের। তাই এই অঞ্চলের অনেক লোকই পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

পাথর উত্তোলনকারী; Photo © Writer

পাথর উত্তোলনের জন্যে বিশালাকারের রাবারের টিউব নিয়ে মহানন্দা নদীর মাঝে চলে যান পাথর সংগ্রহকারীরা। নদীর মাঝ থেকে কখনো কয়েকজন মিলে, আবার কখনো নিজে একাই পাথর তুলে রাবার টিউব ভর্তি করে পাড়ে নিয়ে আসেন। তারপর বিভিন্ন আকৃতির পাথরগুলো থেকে ময়লা ছাঁকিয়ে একটা কাঠের বাক্সে ভর্তি করে নেয়। একটা কাঠের বাক্স একবার ভর্তি হলে সেটাকে এক সেপটিক বা এক ফেরা বলে।
নদীর পাথর উত্তোলনের মাঝে ওপাড়ে চোখ পড়তেই ভারতের কাঁটাতারের সীমানা দেখলাম এবং বামপাশে দূরে একটা ব্রিজ দেখলাম। সেটাকে অনেকে বড় ব্রিজ বলে, আবার অনেকে স্লুইস গেট বলে কেননা একইসাথে স্লুইস গেটের কাজ এবং যানবাহন চলাচলের কাজ হয় এই ব্রিজ দিয়ে। অনেকে আবার জলপাইগুড়ি ব্রিজ বলে, কেননা ধারণা করা হয়, ভারতের জলপাইগুড়ি অংশটা ঐদিকেই অবস্থিত।

জুম লেন্সে দূরের জলপাইগুড়ি ব্রীজ; Photo © Writer

পঞ্চগড় যাত্রা ও কিছু কথা

অটোতে করে ফিরে এলাম তেঁতুলিয়া বাস স্ট্যান্ড। বোর্ডবাজার যাওয়ার বাসের জন্যে অপেক্ষায় আছি সবাই। বোর্ডবাজার নেমে ৫ কিলোমিটার ভেতরেই মহারাজার দীঘি এবং ভেতরগড় দুর্গ। আমাদের দলের মধ্যে দুজন হঠাৎ করেই বলে বসলো তাদের শরীর খারাপ লাগছে। আর তখন রোদের তাপে বেশ খানিকটা ভ্যাপসা গরমও লাগছিল। টানা ১৩ ঘন্টার যাত্রা, ঘুমহীন রাত, কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে ঘোরাঘুরি, তার উপর ভ্যাপসা গরম- এত ধকল তাদের শরীর সামলাতে পারেনি হয়তো। যা-ই হোক, যেহেতু সেখানকার বেশিরভাগ বাসই লোকাল, তাই দুজনের কথা চিন্তা করে এককথায় বাধ্য হয়েই অটো ঠিক করলাম একেবারে পঞ্চগড় সদর পর্যন্ত।
অটোতে করে যখন বোর্ডবাজারের কাছাকাছি, তখন অটো চালককে আমি বললাম ভেতরে যেতে, এজন্য আলাদা করে ভাড়া বাড়িয়ে দেবো। তিনি আমাকে বললেন, সকালেই এক দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু অতিরিক্ত কুয়াশা থাকার কারণে ভেতরগড় দুর্গ পুরোটা পলিথিন দিয়ে ঢাকা। আরো বললেন, সাধারণত বৃষ্টির দিনে এবং অতিরিক্ত কুয়াশার দিনে এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের খনন কাজ বন্ধ থাকে এবং পলিথিন দিয়ে পুরোটা নিদর্শন ঢেকে রাখা হয়। ভেতরে ১০ কিলোমিটার রাস্তা গিয়ে যদি কিছুই দেখতে না পারি, তবে না যাওয়াটাই ভালো- এমন চিন্তাতেই মহারাজার দীঘি দেখার কথাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম।

এই তেঁতুল গাছের নামেই জায়গার নাম তেতুলিয়া হয়েছে; Photo © Writer

তেঁতুলিয়া থেকে পঞ্চগড় সদর আসতে প্রায় সবকটা থানাই পেড়িয়ে আসতে হয়। এবং প্রত্যেকটা থানাতেই কিছু না কিছু দেখার আছেই। তবে দেখতে চাইলে অবশ্যই আপনাকে সময় নিয়ে আসতে হবে এবং গ্রামের ১০/১২ কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে দেখতে হবে। আমাদের সময় ছিল সীমিত। তখন বাজে তিনটার কাছাকাছি। পঞ্চগড় মহিলা কলেজ চলে এলাম বাংলাদেশের একমাত্র রকস মিউজিয়াম দেখে যাব বলে। অটো থেকে নেমে পারমিশন নেয়ার জন্যে কলেজের ভেতরে গেলাম।
কিন্তু ভেতরে ঢুকেই মনটা খারাপ হয়ে গেল কেননা সেদিন কলেজে পরীক্ষা চলছিল যা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। তারপরও অধ্যক্ষ স্যারের দেখা পেলাম। তিনি আমাদের দেখাতে পারছেন না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। আর তার পরেরদিনও দেখার কোনো সুযোগ নেই, কেননা পরের দিন বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠান আছে। কী আর করা! অগত্যা চলে এলাম সেখান থেকে। পঞ্চগড় সদরে খুব সম্ভবত এক ব্রাহ্মণ হোটেলে খাবার খেয়ে বের হয়েই শুনলাম শীতকালের জন্যে পঞ্চগড় থেকে ঠাকুরগাঁওগামী শেষ বাস যায় ৫-৫:৩০ এর মধ্যে। তাই যতটুকু ঘুরে দেখতে পেরেছি ততটুকুর শান্তি নিয়েই ঠাকুরগাঁওয়ে গেস্ট হাউজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যেতে সময় লাগে আরো দেড় থেকে দুই ঘন্টা। কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি এবং বিভিন্ন স্থান না দেখতে পারার দুঃখ এক নিমিষেই মিলিয়ে গেল ঠাকুরগাঁওয়ের আরডিআরএস গেট হাউজে বাইরের আর ভেতরের চমৎকার পরিবেশ দেখে। পরের পর্বে ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুর নিয়ে বিস্তারিত থাকছে।

কোন এক গ্রামের রাস্তা; Photo © Writer

পঞ্চগড়ের দর্শনীয় স্থান সমূহ

একটা পর্যটন নগরীর হওয়ার জন্যে যেসব উপাদানের প্রয়োজন তার সবকিছুই পঞ্চগড়ে আছে এবং পঞ্চগড়ে দর্শনীয় স্থানও অনেক আছে। তবে পঞ্চগড় ছোট জেলা হলেও দর্শনীয় স্থানগুলোর দূরত্বের উপর ভিত্তি করে একদিনে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। আর আমাদের মতো ভরা শীতকালের দিনে তো সম্ভবই না, তবে দীর্ঘ লম্বা দিনে হয়তো সম্ভব হতেও পারে।
১. ভিতরগড় দুর্গ;
২. মহারাজার দীঘি (প্রায় ১৫০০ বছর প্রাচীন) ও কাজল দীঘি;
৩. রকস মিউজিয়াম; (বাংলাদেশের একমাত্র পাথরের যাদুঘর)
৪. বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর ও জিরো পয়েন্ট;
৫. তেঁতুলিয়া ডাক বাংলো এবং পিকনিক স্পট;
৬. মির্জাপুর শাহী মসজিদ; (প্রায় ৪০০ বছর পুরানো)
৭. ছেপড়াঝাড় পাহাড়ভাঙ্গা মসজিদ; (প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো)
৮. বার আউলিয়ার মাজার;
৯. গোলকধাম মন্দির;
১০. বদেশ্বরী পিঠ মন্দির; (এ মন্দির বাংলাদেশে দুটি আছে কেবল। এটি এবং সীতাকুন্ডে একটি)
১১. জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি;
১২. সমতল ভূমির চা-বাগান এবং কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট বাংলো;
১৩. দেবীগঞ্জ সেতু ও ধরধরা রেল সেতু;
১৪. এশিয়ান হাইওয়ে, রবীন্দ্র চত্বর ও নজরুল চত্বর;
১৫. মীরগড়ের অবশিষ্ঠাংশ; হোসেনগড় বর্তমানে ভারতীয় ভূখন্ডে চলে গেছে। দেবেনগড়, রাজনগড় এবং মীরগড়ের বেশিরভাগ অংশই এখন বিলুপ্তপ্রায়।
১৬. মহানন্দী নদী, পাথর উত্তোলন এবং ভারতের জলপাইগুড়ি ব্রীজ;
১৭. কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন; (হেমন্তকালে এবং শীতের শুরুতে কিংবা শেষের দিকে);
১৮. বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেডিয়াম;
পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক সংস্কৃতির জনপ্রিয় গান হচ্ছে ‘হুলির গান’। অনেকটাই পালা শ্রেণীর গান। যদিও বা, সনাতন ধর্মের হুলি পূজার নাম থেকে এই নামের উৎপত্তি তা সত্ত্বেও এই গানে ফুটে ওঠে সমসাময়িক জীবনযাপনের অসংগতির চিত্র, দুঃখ-বেদনা-সুখ কিংবা প্রেমের ইতিহাস। কখনো তা রসাত্মকভাবে আবার কখনো তা ব্যাঙ্গত্মকভাবে উপস্থাপন করা হয়। এই গানে একজন ছোকরা (মেয়ের সাজে ছেলে) এবং একজন সং (জোকার) থাকেন যারা বিভিন্ন নাটকীয়তার সাথে সাথে কাহিনীর ধারাবাহিক বিন্যাস করেন। বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত হতে হয় এই গানে অংশগ্রহণ করতে চাইলে। একেকটা গানে প্রায় ১০-১২ জন পর্যন্ত অংশগ্রহণ করে থাকেন। কাসর, সারঙ্গী, ঢোল বাঁশি সহ আরো বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করা হয় এ গানে।

চলতি পথে তোলা একটি ছবি; Photo © Writer

আবাসন ব্যবস্থা

পঞ্চগড় পরিপূর্ণভাবে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে উঠতে না পারলেও পঞ্চগড়ে আবাসন ব্যবস্থার স্বল্পতা নেই।
সরকারি আবাসনসমূহ
১. পঞ্চগড় সার্কিট হাউজ;
২. জেলা পরিষদ ডাকবাংলো;
৩. তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো;
৪. বাংলাবান্ধা ডাকবাংলো;
৫. পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের রেস্ট হাউজ;
এছাড়া, তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্ণার, দেবীগঞ্জ ডাকবাংলো, বোদা ডাকবাংলো, আটোয়ারী ডাকবাংলো, কৃষি ফার্ম গেস্ট হাউজ, রেশম প্রকল্প গেস্ট হাউজসহ আরো অনেকগুলো সরকারিভাবে থাকার আবাসনের ব্যবস্থা আছে।
বেসরকারি আবাসনসমূহ
১. মৌচাক আবাসিক হোটেল;
২. সেন্ট্রাল গেস্ট হাউজ;
৩. হোটেল রাজনগর আবাসিক;
৪. হিলটন বোর্ডিং;
৫. হোটেল প্রীতম আবাসিক;
এছাড়া, হোটেল ইসলাম, এইচ কে প্যালেস, নীরব গেস্ট হাউজ, রোকসানা বোর্ডিং, ইসলাম আবাসিক হোটেল, মুন স্টার সহ আরো অনেকগুলো আবাসিক হোটেলে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে।পঞ্চগড়ের মানুষজন সহজ সরল এবং অতিথিপরায়ণ স্বভাবের। তাদের সাথে আন্তরিকভাবে কথা বললে তারা খুব খুশি হন এবং নিজে থেকেই যেকোনো সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসেন। পঞ্চগড়ের মানুষজনের আরেকটা স্বভাব হচ্ছে, তারা চান তাদের জেলাটাও যেন পর্যটনের নগরী হিসেবে পরিচিতি পায়। তাই তারা চান আরো বেশি পর্যটক আসুক। সাধারণত অন্যান্য জায়গায় অপরিচিত বা পর্যটক দেখলেই দাম বাড়িয়ে নেয়, কিন্তু পঞ্চগড়ে এটা খুবই কম। পঞ্চগড় দুর্যোগপ্রবণ জেলা নয়, আবার এখানকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্য যেকোনো জেলার চাইতে শান্তিপূর্ণ। তবে পঞ্চগড়ে ঘুরতে হলে সবচাইতে ভালো হেমন্তকাল কিংবা শীতের শুরু অথবা শীতের একদম শেষে। দিনটা বড় থাকলে একদিনে অনেকগুলা দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করা সম্ভব।
তবে পঞ্চগড়ের যাতায়াত ব্যবস্থা অন্যান্য পর্যটন নগরীর মতো উন্নত নয়। তাই যেখানেই যাবেন রিজার্ভ করে যাবেন যাতে ঘুরে দেখে বের হয়ে আবার অন্য কোথাও যেতে পারেন। অথবা দল বেঁধে গেলে মাইক্রো বা ভ্যান ভাড়া করে নিতে পারেন। যদিও অনেক জায়গায় মাইক্রো ছেড়ে অটোতেই উঠতে হতে পারে। আর পঞ্চগড়ের স্থানীয় বাসের ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য দেয়াটা মুশকিল, কেননা আগে সাদা পতাকা লাগানো বাসগুলো ছিল গেটলক সার্ভিস। কিন্তু বর্তমানে কয়েক রঙের পতাকা লাগানো বাস আছে এবং সবাই-ই নিজেদের গেটলক বলে। আদতে কে যে গেটলক তা খুঁজে বের করা মুশকিল!
টানা ১৩ ঘন্টার যাত্রা করে এসে ন্যূনতম বিশ্রাম না নিয়ে ঘোরাঘুরির ক্লান্তি, না ঘুমানো এবং ব্যাকপ্যাকের ভারে শরীরের ব্যথা এবং পঞ্চগড়ে ঠিকভাবে ঘুরে দেখতে না পারার অভিমানগুলো এক নিমিষে মিলিয়ে গেলে ঠাকুরগাঁও আরডিআরএস গেস্ট হাউজের বাইরের এবং ভেতরের পরিবেশ দেখে। যদিও হোটেলের মতোই দুটো চারতলা বিল্ডিং, তবে আশেপাশের গাছগাছালির পূর্ণতা অন্তত ব্যবসায়িক হোটেল থেকে একে ভিন্ন করেছে।
আরডিআরএস হচ্ছে রংপুর এবং দিনাজপুর কেন্দ্রিক বেসরকারী দেশীয় এনজিও সংস্থা। এই গেস্ট হাউজটি শুধুমাত্র অফিশিয়াল কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, ব্যবসায়িক অভিপ্রায়ে নয়। তাই চাইলেই এখানে থাকা যাবে না। এখানে থাকার জন্যে এনজিও’র উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার খুব জোরালো রেফারেন্স থাকতে হবে এবং যদি গেস্ট হাউজের রুম খালি থাকে সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে নিজেদের পরিচয় জানালে পরে ওখান থেকে যাচাই করে মেইল করে হ্যাঁ বা না জানানো হয়। আমাদের সাথে সাজিদা ফাউন্ডেশনের এডমিন পর্যায়ের একজন ছিলেন, যার মাধ্যমে এখানে থাকা হয়েছে।

আরডিআরএস গেস্ট হাউজ; Photo: Muhammad Ali Shuvo

বিশ্রাম নিয়ে রাত ৮টার দিকে বের হয়ে একটা অটো নিয়ে বললাম শহরের আশেপাশে এক ঘন্টা ঘুরিয়ে নামকরা এক হোটেলে নামিয়ে দিতে। অটো চালক ভাই খুব খুশি মনেই আমাদের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখাতে লাগলো। রাত বলে সাথে করে ক্যামেরা আনা হয়নি। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই মোবাইল চার্জ না থাকায় এবং চলতি গাড়িতে থাকায় ঠাকুরগাঁওয়ের কোনো ছবি তোলা হয়নি। অবশ্য দর্শনীয় তেমন কোনো স্থানও দেখতে পারিনি। জেলা শহরের প্রশাসনিক নান্দনিক ভবন এবং কিছু ভাষ্কর্য আর কয়েকটা নামিদামি জায়গা এসবই দেখা হয়েছে অটোতে করে। চালক ভাই ঠাকুরগাঁও এর নামকরা মনতাজ হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলেন। খাবারের স্বাদ ভালোই।

গেস্ট হাউজের সকাল; Photo © Writer

ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

আয়তন আর পরিসরের দিক থেকে ছোট জেলা হলেও প্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জনপদের একটি হচ্ছে ঠাকুরগাঁও। এই জেলার আদি নাম ছিল নিশ্চিন্তপুর। নিজেদের ঐতিহ্য বাদেও এই জনপদ এর আশেপাশের অঞ্চলের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে টিকে আছে। হাজার বছর ধরে নিজেদের ভাষা আর সংস্কৃতিকে আগলে ধরে রাখলেও বর্তমানে নতুন জোয়ারের পালাবদলের দিনে তারা বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ব্রিটিশ শাসনামলে কুলিক, পাথরাজ, শুক, টাঙ্গন এবং ঢেপা বিধৌত এই জনপদগুলো নিয়ে তৎকালীন এক ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে একটা থানা স্থাপিত হয়। সনাতন ধর্মের ব্রাহ্মণ গোত্রের সংখ্যাধিক্য এবং ঠাকুর পরিবারের অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ঐ জায়গাকে তখন থেকেই ঠাকুরগাঁ থানা নামে অভিহিত করা হয়। তবে স্থানীয়দের মধ্যে জনশ্রুতি আছে, সতীশ চক্রবর্তী এবং নারায়ন চক্রবর্তী নামে দুই ভাই বাস করতেন এ এলাকায়। প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং সম্পদের প্রাচুর্যতার কারণে এলাকায় তাদের বেশ নাম-ধাম ছিল এবং লোকজন তাদেরকে সম্মানার্থে ঠাকুর সম্ভোধন করতেন। তাদের বাড়িকে ঠাকুরবাড়ি। এভাবেই ঠাকুরবাড়ি থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে পরিণত হয়েছে।

ঠাকুরগাঁও জেলার মানচিত্র; Image Source: thakurgaon.gov.bd

১৮৬০ সালে সদর, হরিপুর, রাণীশংকৈল, পীরগঞ্জ, বালিয়াডাঙ্গি এবং আটোয়ারি এই ছয়টি থানা নিয়ে একে মহকুমায় উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ভারতের কুচবিহারের ১টি থানা এবং জলপাইগুড়ির ৩টি থানাসহ সর্বমোট ১০টি থানা নিয়ে ঠাকুরগাঁও মহকুমা নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ভারত নিজেদের থানাসমূহ নিজেদের দখলে নিয়ে নিলে এবং ১৯৮১ সালে পঞ্চগড় নামে আলাদা একটি মহকুমা আত্মপ্রকাশ করলে ঠাকুরগাঁওয়ের সীমানা কমে ৫টি থানায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৪ সালের পহেলা ফ্রেবুয়ারি ঠাকুরগাঁও সদর, হরিপুর, রাণীশংকৈল, পীরগঞ্জ এবং বালিয়াডাঙ্গি এই ৫টি থানা মিলিয়ে ঠাকুরাগাঁও জেলা আত্মপ্রকাশ করে।

ঠাকুরগাঁওয়ের দর্শনীয় স্থানসমূহ

ঠাকুরগাঁওয়ের বেশ কিছু পুরাকীর্তি এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থাকলেও পর্যাপ্ত দেখভালের অভাবে এসব দিনকে দিন বিলুপ্তপ্রায়। তা সত্ত্বেও এখানে প্রচুর দর্শনীয় স্থান আছে। সময় নিয়ে পুরো ঠাকুরগাঁও ঘুরে দেখা যেতে পারে।
০১. ছোট বালিয়া জামে মসজিদ (জ্বিনের মসজিদ খ্যাত- শতবর্ষাধিক পুরনো);
০২. শালবাড়ি মসজিদ ও ইমামবাড়া;
০৩. জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ (প্রায় ১৫১ বছরের পুরানো);
০৪. মহালবাড়ি মসজিদ;
০৫. মেদিনী সাগর জামে মসজিদ;
০৬. ফতেহপুর মসজিদ;
০৭. সনগাঁও শাহী মসজিদ;
০৮. গেদুড়া মসজিদ;
০৯. পীর নাসিরউদ্দিন শাহ বা পীর নেকমরদ শাহের মাজার শরীফ;
১০. ঐতিহ্যবাহী বালিয়াডাঙ্গী সূর্য্যপুরী আমগাছ (প্রায় ১৫০ বছর পুরনো এবং এশিয়ার বৃহত্তম আম গাছ);
১১. রাণীশংকৈল জমিদারবাড়ি বা রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি (প্রায় ১০৩ বছরের পুরনো);
১২. রামরাই দীঘি (প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো);
১৩. হরিপুর জমিদারবাড়ী বা হরিপুর রাজবাড়ী (প্রায় ১২৫ বছরের পুরনো);
১৪. প্রাচীন রাজভিটা (এতটাই পুরাতন যে সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায়নি);
১৫. গোরক্ষনাথ মন্দির, কূপ এবং শিলালিপি (বাংলাদেশের আবিষ্কৃত অন্যতম প্রাচীন শিলালিপি);
১৬. হরিণমারী শিব মন্দির (প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো);
১৭. জগদল রাজবাড়ি;
১৮. বলাকা উদ্যান ও ফান সিটি এমিউজমেন্ট পার্ক এবং লোকায়ন জীবন বৈচিত্র্য জাদুঘর;
১৯. প্রাচীন জনপদের রাজধানীর চিহ্ন নেকমরদ;
২০. গোবিন্দনগর মন্দির, ঢোলরহাট মন্দির, ভেমটিয়া শিবমন্দির, রামচন্দ্র মন্দির, নাথ মন্দির ও খোলা হাট মন্দির;
২১. খুনিয়া দীঘি, খুরন্মম খুয়া দীঘি, শাপলা পেয়ালা দীঘি;
২২. কোরমখান গড়, বাংলা গড়, গড় ভবানীপুর, গড়খাড়ি, সাপটি বুরুজ;
২৩. মালদুয়ার দুর্গ বা জমিদারবাড়ি ও গড়্গ্রাম দুর্গ;
২৪. অপরাজেয় ৭১, শহীদ মোহাম্মদ আলী স্টেডিয়াম;
২৫. ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস ও জামালপুর স্টেট;
ঠাকুরগাঁওকে বলা হয় বারো মাসে তেরো পার্বণের জেলা, কেননা এখানে সবসময়ই উৎসবমুখর আমেজ বিরাজ করে। দিনশেষে ক্লান্ত কৃষকের ঘরের দাওয়ায় বসে পুঁথি কিংবা পালা গানের আসর। সোনাভানের পুঁথি, দেওয়ান ভাবানার পালাপাঠ, ভাওয়াইয়্যা, ভাটিয়ালি, পলস্নী গান, কোয়ালী গান, বিষহরি গান, সত্যপীরের গান, কবিগান, পালাগান এবং আদিবাসীদের গানসহ বিভিন্ন ধরনের গানের সমারোহ এবং অনুষ্ঠানের দেখা মেলে ঠাকুরগাঁওয়ে। তবে বর্ষাকালে বুড়ির বাঁধের মৎস্য উৎসব ঠাকুরগাঁওয়ের অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাষ্কর্য অপরাজেয়'৭১; Image Source: banglatribune.com

আবাসন ব্যবস্থা

যদিও ঠাকুরগাঁওয়ে ঘুরতে আসা পর্যটকদের সংখ্যা সাধারণত কমই হয়, তবুও এখানে আবাসন সংকট নেই।
সরকারি আবাসনসমূহ
০১. ঠাকুরগাঁও সার্কিট হাউজ;
০২. জেলা পরিষদ ডাকবাংলো (নতুন);
০৩. ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস রেস্ট হাউজ;
০৪. পানি উন্নয়ন বোর্ড রেস্ট হাউজ;
০৫. পল্লী বিদ্যুৎ গেস্ট হাউজ;
এছাড়া, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ এবং এলজিইডি সবকটা সরকারি ভবনেরই নিজস্ব ডাকবাংলো কিংবা রেস্ট হাউজ আছে।
বেসরকারি আবাসনসমূহ
০১. হোটেল সালাম ইন্টারন্যাশনাল;
০২. হোটেল প্রাইম ইন্টারন্যাশনাল;
০৩. হোটেল সাদেক;
০৪. হোটেল শাহজালাল;
০৫. আবাসিক হোটেল;
এছাড়া, মানব কল্যাণ পরিষদ, আরডিআরএস গেস্ট হাউজ এবং ইএসডিও এর কটেজে পাবেন থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা।
ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষজনও বেশ মিশুক। খুব সহজেই সখ্যতা গড়তে জানে তারা। অনেক প্রাচীন পুরাকীর্তি থাকা সত্ত্বেও পর্যটকের পরিমাণ খুবই কম, তাই ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষজন পর্যটকদের সমীহ করে সবসময়ই। ঠাকুরগাঁও জেলাও শান্তিপূর্ণ জেলা। হেমন্তকালে মাঝে মাঝে ঠাকুরগাঁওয়ের আকাশ থেকেও কাঞ্চনজংঘা দেখা যায়। ঠাকুরগাঁও অনেক দিক থেকেই পঞ্চগরের চাইতে উন্নত, তাই এই জেলার যাতায়াত ব্যবস্থাও অতি উন্নত। একনজরে ঠাকুরগাঁও দেখার জন্যে এখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন।

রাজা টংকনাথের পরিত্যক্ত বাড়ি; Photo: Alif Arifur

পরিকল্পনার অদল-বদল

গেস্ট হাউজে রাতেই সবাই মিলে পরিকল্পনা করলাম যে, পঞ্চগড় অর্থাৎ পেছন দিকে ফেরত যাওয়ার কোনো দরকার নেই এবং ঠাকুরগাঁও ঘুরতে যাবো না। কেননা, আমরা ছিলাম দিনাজপুর রোডে এবং সেখান থেকে দিনাজপুর অনেক কাছে। অবশ্য, আমি নিজে আট বছর আগে অর্থাৎ ২০১০ সালে দিনাজপুর ঘুরে এসেছি। তবে সেবার পুরো দিনাজপুর ঘোরা হলেও কান্তজিউ মন্দিরটাই দেখা বাকি ছিল। রাতে আবার ফেসবুকে জানতে পারলাম, দুই কাছের বন্ধু বর্তমানে ওদের বাড়িতেই আছে, মানে দিনাজপুরেই আছে এবং যাওয়ার জন্যে জোর করলো। তাই ঠাকুরগাঁওয়ের দর্শনীয় স্থান বাদ দিয়ে বাধ্য হয়েই দিনাজপুরের পরিকল্পনা করলাম।

দিনাজপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে হাজার বছরের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে আজও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে এই দিনাজপুর শহর। বিশেষজ্ঞরা দিনাজপুরের এই মাটিকে ভারতের বিন্ধ্যা, ছোট নাগপুরের সমগোত্রীয় লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাচীন মাটির সমতুল্য বলে মনে করেন। প্রাচীনকালে চৈনিক এবং বিভিন্ন সময়ের ইউরোপীয় ভ্রমণকারীদের বিবরণীতে করতোয়া নদীর তীরের এক উন্নতা সভ্যতার কথা শোনা যায়, যাকে ঐ সময় করতোয়া সভ্যতাও বলা হত। ধারণা করা হয়, মধ্যযুগের মহাস্থানগড় এবং মোঘল আমলের দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটই ছিল এই সভ্যতার কেন্দ্র। ইতিহাস বিখ্যাত পঞ্চনগরীও তখন এই দিনাজপুরেই অবস্থিত ছিল।

মাটির চুলা; Photo © Writer 

লোকশ্রুতি অনুযায়ী, দিনাজপুর রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দিনাজ অথবা দিনারাজ এর নামানুসারেই রাজবাড়ীর মৌজার নাম ছিল দিনাজপুর। বাংলায় নবাবী শাসন পতনের আট বছর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোঘলদের বানানো রাজধানী ঘোড়াঘাট নগর দখল করে এবং প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে নতুন জেলা গঠন করে রাজার সম্মানার্থের এই জেলার নামকরণ করে দিনাজপুর। এরপর থেকেই দিনাজপুর শহর গড়ে উঠতে শুরু করে।
দিনাজপুরের গেজেটিয়ার থেকে জানা যায়, ১৭৮৩ সালে প্রশাসনিক ভাবে জেলা শাসনের জন্যে এই শহরে স্বতন্ত্র স্থায়ী কালেক্টরেট স্থাপন করা হয়। এর আগ অবধি দিনাজপুর এবং রংপুরের যুক্ত কালেক্টরেট ছিল। পরবর্তীতে ১৭৮৬ সালে দিনাজপুরকে নতুন জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৭৯৩ সালে জেলা দপ্তর গঠন করা হয়। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর এই জেলা দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ ভারতের দখলে চলে যায় এবং অন্য ভাগ এদেশেই রয়ে যায়। পরে দিনাজপুর জেলার দুটি মহকুমা পঞ্চগড় এবং ঠাকুরগাঁও আলাদা জেলা রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

দিনাজপুরে মাটির চুলায় দুধ জ্বাল দিয়ে এমন গ্লাসে করে পরিবেশন করা হয় দুধ চা। Photo © Saiful Islam Uzzol

দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ

কান্তজিউ মন্দির ও রাস মেলা উপভোগ
ঘুম থেকে উঠেই আগের রাতে এনে রাখা কলা আর পাউরুটি দিয়েই সকালের নাস্তা সেরে অটোতে করে চলে গেলাম ঠাকুরগাঁও পুরাতন বাসস্ট্যান্ড। উদ্দেশ্য দিনাজপুরের বিখ্যাত কান্তজিউ মন্দির এবং এর আশেপাশে ঘুরে দেখে। ঢোকার সাথে সাথেই দিনাজপুরের গেটলক বাস পেয়ে গেলাম এবং দিনাজপুর কাহারোলের বারো মাইলের টিকেট কেটে উঠে পড়লাম বাসে। বাসে থাকা অবস্থাতেই হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বীরগঞ্জ জাতীয় উদ্যানের দেখা মিলল।

তেভাগা চত্বরের ভাষ্কর্য; Photo © Writer

বাস থেকে নেমেই রাস্তা পার হতে গিয়ে দেখলাম তেভাগা আন্দোলন স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য। নীচের নামফলকে ইলা মিত্রসহ তেভাগা আন্দোলনের অন্যান্য যোদ্ধাদের বিবরণ দেয়া এবং আন্দোলনের কিছু দৃশ্য টেরাকোটায় করা। পরে শুনলাম, এই জায়গাটাকে তেভাগা চত্বরও বলে স্থানীয়রা। তেভাগা চত্বরের পেছনেই ঢেপা নদীর ব্রিজ। ব্রিজের শেষ মাথা থেকেই কান্তনগরের শুরু।
অটোতে করে চলে গেলাম কান্তজিউ মন্দির। যাবার পথে কান্তজিউ মন্দির পুরাকীর্তি যাদুঘর এবং পর্যটনের মোটেল দেখলাম। অটো থেকে নেমে দেখলাম প্রচুর ভিড়। ঘটনা কী জানার জন্যে চালক ভাইয়ের দিকে তাকানো মাত্রই তিনি জানালেন, শতবর্ষেরও বেশি প্রাচীন রাস মেলা চলছে। একের ভেতর দুই। চারিদিকে উৎসবের আমেজ। মন্দিরে প্রবেশপথকে ঘিরে বিভিন্ন খাবার-দাবার এবং পণ্যের সমাহারে সেজেছে মেলা। একে তো মেলা, তার উপর আবার বিজয় দিবসের ছুটি, তাই অনেক বেশিই মানুষ ছিল সেদিন। মন্দিরের প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকেই পোড়ামাটির এই মন্দির দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল।

রাসমেলায় জনারণ্য কান্তজিউ মন্দির; Photo © Writer

এদেশে বিখ্যাত যে কয়েকটি প্রাচীন স্থাপত্য আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কান্তজিউ মন্দির। দিনাজপুর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে ঢেপা নদীর তীরে সুন্দরপুর ইউনিয়নে অবস্থান এই মন্দিরের। মন্দির উত্তর দিকে ভিত্তিবেদী থেকে জানা যায়, মহারাজা প্রাণনাথ রায় ১৭০৪ সালে এই মন্দিরের নির্মাণকাজের সূচনা করেন। তবে ১৭২২ সালে মৃত্যুর আগে তিনি এই মন্দিরের কাজ পূর্ণ করার দায়িত্ব দিয়ে যান পোষ্যপুত্র মহারাজ রামনাথ রায়কে। রামনাথ রায় ১৭৫২ সালে এই মন্দিরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন।

পোড়ামাটির টেরাকোটা শিল্প; Photo © Writer 

পাথরের উঁচু বেদীর উপর নির্মিত তিনতলা বিশিষ্ট এই বর্গাকার মন্দিরটির উচ্চতা ৫০ ফুট। এই মন্দিরের নয়টি চূড়া রয়েছে, যার জন্য একে নবরত্ন মন্দিরও বলা হয়। তবে শুরুতে এর উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পের কবলে পড়ে চূড়াগুলো ভেঙে যায় এবং পরে চূড়াগুলো ছাড়াই এই মন্দিরের সংস্কার কাজ করা হয়। মন্দিরের প্রতি তলার চারপাশেই খোলা বারান্দা। আর প্রত্যেক তলাতেই খিলান যুক্ত দরজা দেখা যায়। তবে এই খিলানগুলো এমন ভঙ্গিমায় বানানো হয়েছে, যাতে করে মন্দিরের সব দিক থেকেই ভেতরে রাখা দেবমূর্তি যেন সকল পূজারীই দেখতে পায়।

মন্দিরের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি; Photo © Rupok 

মন্দিরের ভিত্তির একদম নীচ থেকে শুরু করে একদম চূড়া অবধি পৌরাণিক কাহিনীচিত্র বিশ্লেষণ করে পোড়ামাটির ফলক ব্যবহার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সর্বমোটা পনের হাজারেরও অধিক পোড়ামাটির টেরাকোটা শোভা পাচ্ছে এই মন্দিরের পুরোটা জুড়ে। রাধা-কৃষ্ণ থেকে শুরু করে মোঘল বাদশাহ, জমিদার এবং সাধারণ মানুষজনের জীবনযাপনের দৃশ্যও বর্ণিত হয়েছে এসব টেরাকোটায়। মূল মন্দির প্রাঙ্গনেই একটি শিব মন্দির আছে। সেখানে শিবের পূজা করা হয়।
চোখ ধাধানো এই মন্দিরের সৌন্দর্য অবলোকন করে বের হয়ে রাসমেলায় জমজমাট প্রাঙ্গন পেরিয়ে চলে এলাম মূল সড়কে। সেখান থেকে একটি অটো নিয়ে চলে গেলাম নয়াবাদ জামে মসজিদ দেখতে। কান্তজিউ মন্দির থেকে অটোতে করে ২০ মিনিট সময় লাগে যেতে। আর যদি রাস্তা পার হয়ে ক্ষেতের উপর দিয়ে চলে যেতে পারেন, তাহলেও হেঁটে যেতে ১৫-২০ মিনিট লাগবে। এই বুদ্ধি আমার দিনাজপুরের বন্ধু দিলেও শুনিনি আমি। তাই অটোতে করেই লিচু বাগানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলাম নয়াবাদ জামে মসজিদের দিকে।

কান্তজিউ মন্দির; Photo © Writer

লিচু বাগান ও নয়াবাদ জামে মসজিদ দর্শন

যাত্রাপথেই লিচু বাগানের ফাঁকা দিয়েই কালের সাক্ষী হয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা নয়াবাদ জামে মসজিদ দেখতে পেলাম। স্থানীয়ভাবে এই মসজিদটি বিচিত্র মসজিদ নামেও পরিচিত। মসজিদের প্রধান দরজার উপর স্থাপিত ফলক থেকে জানা যায়, ১.১৫ বিঘা জায়গার উপর নির্মিত এই মসজিদটি সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের রাজত্বকালে ২রা জৈষ্ঠ্য ১২০০ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ইংরেজী ১৭৯৩ সালে নির্মিত হয়েছে, যা কি না কান্তজিউ মন্দির নির্মাণের ৪১ বছর পর।

নয়াবাদ জামে মসজিদ; Photo © Writer

লোকমুখে শোনা যায়, এই মন্দিরের এবং মসজিদের নির্মাতা একই। আরো প্রচলিত আছে, এই মন্দিরের নির্মাতাদের অধিকাংশই ছিল পারস্য থেকে আগত মুসলিম। আর বেশ অনেকটা সময় ধরে এই গ্রামে বসবার করার ফলে নিজেদের জন্যে তারা এই মসজিদ নির্মাণ করেন।
তিন গম্বুজ বিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের চারকোণে চারটি অষ্টভূজ মিনার আছে। মসজিদটির বাইরের দিক থেকে মাপে দৈর্ঘ্য ১২.৪৫ মিটার এবং প্রস্থ ৫.৫ মিটার। আর এর সাথে দেয়ালের প্রশস্ততা আছে ১.১০ মিটার। মসজিদটি অর্ধ-গোলাকৃতির তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। তিনটির গম্বুজের মধ্যে মাঝের গম্বুজটি তুলনামূলক বড় পাশের দুটো গম্বুজের তুলনায়। গম্বুজের বৈচিত্র্যের জন্য পেন্ডেটিভ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাচীর এবং কার্নিশগুলো একদম সমান্তরাল।

মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথ; Photo © Writer

পূর্ব দিকের তিনটি খিলান দরজাই মূলত মসজিদে প্রবেশের জন্যে ব্যবহার করা হয়। তিনটি খিলানের মাঝেরটি পাশের দুটি থেকে বড়। মাঝের খিলানটির উচ্চতা ১.৯৫ মিটার এবং প্রস্থ ১.১৫ মিটার। উচ্চতায় পাশের খিলান দুটি সমমাপের হলেও প্রস্থের অনুপাতে খিলান দুটো মাঝের খিলানটি থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট। এই প্রবেশদ্বারগুলো বহু খাঁজ কাঁটা কৌশলে নির্মিত।
মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দিকে খিলান বরাবরই তিনটি মেহরাব আছে। খিলানের মতোই এই মেহরাবগুলোর মধ্যে মাঝের মেহরাবটি পাশের দুটো মেহরাব থেকে অপেক্ষাকৃত বড়। এই মেহরাবটির উচ্চতা ২.৩০ মিটার এবং প্রস্থ ১.০৮ মিটার। পাশের মেহরাব দুটো খিলানের মতোই মাঝের মেহরাব থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট। মসজিদের ভেতরের উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে বহু খাঁজযুক্ত দুটি জানালাও আছে। 
মসজিদের চারকোণের অষ্টভূজাকৃতির মিনারগুলোর মধ্যে দুটির উপরে আছে গম্বুজ এবং বাকি দুটির উপর আছে কুপলা বা ছোট্ট গোলাকার গম্বুজই, তবে খানিকটা ভিন্ন। কুপলা দুটো অনেকটাই দেখা গেলেও গম্বুজ দুটো অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। মিনারগুলো ইট আর পলেস্তারা দিয়েই সরু আকৃতির করে বানানো হয়েছে। উপরের গম্বুজের অংশে বাতিদানের জন্যে ছত্রীর ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।

এভাবেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নয়াবাদ জামে মসজিদ; Photo © Writer 

মসজিদের দেয়ালজুড়ে অনিন্দ্যসুন্দর টেরাকোটার কাজ মুগ্ধ করে। সংস্কারের অভাবে বেশিরভাগ টেরাকোটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে ইতিমধ্যেই মসজিদের সীমানা দেয়াল দিয়ে মাদ্রাসা বানানো হয়েছে, দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা, ওজুখানা এবং টয়লেটও নির্মাণ করা হয়েছে। শীঘ্রই মসজিদের সংস্কারের কাজও করা হবে।
প্রাচীন নিদর্শনের কাছে এসে বর্তমানের সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম আমরা। মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকেই রুবেল ভাইয়ের অটোতে করে তেভাগা চত্বর ফেরত এলাম। সেখান থেকে বাসে উঠে চলে এলাম বটতলী। সেখান থেকে আবার অটোতে করে দিনাজপুর রাজবাড়ি। আমি ২০১০ সালে দিনাজপুর যখন এসেছিলাম, তখনকার রাজবাড়ী আর বর্তমানের রাজবাড়ির মধ্যে অনেক বেশিই তফাত, কেননা তখন অনেক কিছুই ছিল যা এখন পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে শুধুমাত্র সংস্কারের অভাবে। অথচ কান্তজিউ মন্দিরের সমতুল্য এই রাজবাড়িও যথেষ্টে ঐতিহ্য মণ্ডিত।

দিনাজপুর রাজবাড়ি ভ্রমণ 

দিনাজপুরে ১২ জন রাজা প্রায় চারশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজত্ব করেছেন, যাদেরকে মহারাজা বা মহারাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে, কেননা, ধারণা করা হয়, এই রাজারা ছিলেন জমিদার রাজা গণেশের বংশধর। তারা হচ্ছেন রাজা শুকদেব রায়, রাজা রাম দেব রায়, রাজা জয় দেব রায়, রাজা প্রাণ নাথ রায়, মহারাজ রামনাথ রায়, কৃষ্ণ নাথ রায়, বৈধ্য নাথ রায়, মহারাজা রাধানাথ রায়, মহারাজা গোবিন্দ নাথ রায়, তারক নাথ রায়, মহারাজা গিরিজা নাথ রায় বাহাদুর এবং সর্বশেষ মহারাজা জগদীশ নাথ রায়।
দেশ বিভাগের পর জমিদারী প্রথ বিলুপ্ত হলে এই রাজবাড়ি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে রাজবাড়ির ব্যবহৃত জিনিসপত্র সরকারি আদেশে নিলামে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর থেকেই বাড়িটি মূলত সুরক্ষা এবং সংস্কারের অভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে থাকে। বর্তমানে এটি কেবল রাজবাড়ির জমিদারী কৃতির এক ধ্বংসস্তূপ ব্যতীত আর কিছুই না।

দিনাজপুর রাজবাড়িতে বর্তমানে এই ভবনটিই এখনো সুরক্ষিত আছে, বাকিগুলো সব ধ্বংসপ্রাপ্ত; Photo © Writer

এই রাজবাড়ি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজার আমলে নির্মিত হওয়াতে এই প্রাসাদে বিভিন্ন ধরনের, যেমন- হিন্দু, মুসলিম এবং মোঘল স্থাপত্যশৈলী নজরে পড়ে। তবে মূল প্রাসাদের ভবনগুলো তিনটে আলাদা মহলে বিভক্ত ছিল। এগুলো হচ্ছে আয়না মহল, রানী মহল এবং ঠাকুরবাড়ি মহল। এছাড়াও, কুমারমহল, আঁতুড়ঘর, লক্ষ্মীঘর, আটচালা ঘর, কালিয়া জিউ মন্দির, রানী পুকুর, চাঁপা তলার দীঘি এবং ভূতনাথ সহ এই রাজবাড়ির অনেক ঐতিহ্যই হয় হারিয়ে গিয়েছে, নয়তো বর্তমানে হারানোর পথে।

কালিয়া জিউ মন্দিরের দৃষ্টিনন্দন প্রবেশপথ; Photo © Writer

বর্তমানে কালিয়া জিউ মন্দির এবং দুর্গা মন্দির ব্যতীত সম্পূর্ণ রাজবাড়িই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তবে কালিয়া জিউ মন্দিরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। কেননা এই মন্দিরের প্রতিটি ইঞ্চিতে সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায়। আয়নামহল দ্বিতল ভবন, যা বর্তমানে একদমই ধ্বংসপ্রাপ্ত। কালিয়া মন্দিরের প্রবেশপথও দেখার মতো।
যেহেতু আমি আগেই ঘুরে দেখেছি, তাই বেশি দেরি না করেই বের হয়ে গেলাম আমরা, কেননা শীতের সময় দিন ছোট। তার উপর পাঁচটার ভেতরে ঠাকুরগাওয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা না করলে আমরা আমাদের বাস মিস করবো। তাই রামসাগর দীঘি দেখাও বাদ দিতে হলো। বের হয়ে গ্রুপের সবাইকে অটোতে করে দিনাজপুর ঈদগাহ মাঠের সামনে পাঠিয়ে দিলাম।

অযত্ন আর অবহেলায় রাজবাড়ি এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে; Photo © Writer
ধ্বংসস্তূপের মাঝেও নিজের বীরত্ব প্রকাশ করে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে এই ভবনগুলো; Photo © Writer

আর আমি আমার বন্ধুর বাইকের পেছনে খানিকটা স্মৃতি রোমন্থন করে নিলাম, কেননা ২০১০ সালে এসে শুধুমাত্র কান্তজিউ মন্দির বাদে পুরো দিনাজপুরই আমার ঘোরা হয়েছিল। সুখসাগরসহ আরো কয়েকটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে অযত্নে অবহেলায় থাকা দর্শনীয় স্থান দেখে এসে ঢুকলাম দিনাজপুরের বিখ্যাত রুস্তমের হোটেলে।
খাওয়া সেরে পুলিশ ক্যাফেতে বসলাম কিছুক্ষণ, তারপর চলে গেলাম প্রমোদতরীতে। প্রমোদতরী হচ্ছে পুনর্ভবা নদীর তীরে গড়ে উঠা ছোট্ট একটা বিনোদন স্পট। নদীর পাড়ের বিশুদ্ধ বাতাস, প্রকৃতির রূপ এবং নাগরিক জঞ্জাল থেকে সাময়িক মুক্তিই মূলত প্রমোদতরীর প্রধান আকর্ষণ।
আরো বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব জুটে গেলে সময়জ্ঞান হারিয়ে আমরা আড্ডায় মশগুল হয়ে গেলাম। দিনের আলোর তীব্রতা কমতে দেখে আমরা উঠতে বাধ্য হই। এবং দিনাজপুরের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে ফিরে আসি। ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে চলে আসি কাউন্টারে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্যে। আমাদের ট্যুরের এই পর্বের ভিডিওটি পাবেন এখানে। 

দিনাজপুরের দর্শনীয় স্থানসমূহ

দিনাজপুর ছিল রাজাদের আবাসস্থল। তাই এই শহরের যেকোনো জায়গাতেই পাওয়া যায় পুরাকীর্তি এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের দেখা।  তবে পর্যাপ্ত দেখভালের অভাবে এসব দিনকে দিন বিলুপ্তপ্রায়। তা সত্ত্বেও এখানে এখনও প্রচুর দর্শনীয় স্থান আছে।
০১. কান্তজিউ মন্দির;
০২. দিনাজপুর রাজবাড়ি;
০৩. রামসাগর দীঘি;
০৪. নয়াবাদ জামে মসজিদ;
০৫. স্বপ্নপুরী; (বিনোদন পার্ক)
০৬. চেহেলগাজীর মাজার ও মসজিদ;
০৭. শুরা মসজিদ;
০৮. সুক সাগর;
০৯. সীতাকোট বিহার;
১০. সিংড়া ফরেস্ট;
১১. প্রাচীন নগরী কুন্দারনপুর; (ধারনামতে, গ্রীক ইতিহাসে বর্ণিত পেন্টাপলিশ বা পঞ্চনগরীর একটি)
১২. ফুলবাড়ি দুর্গ;
১৩. বারো পাইকে গড়;
১৪. প্রাচীন বেলওয়া নগরী;
১৫. হরিনাথপুর দুর্গনগরী;
১৬. ইতিহাস সমৃদ্ধ নির্শ্বা কাজলদীঘি গ্রাম;
১৭. ঘোড়াঘাট দুর্গ;
১৮. সোনাভানের ধাপ;
১৯. গোপালগঞ্জ পঞ্চরত্ন মন্দির;
২০. চাপড়ার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ;
২১. বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি;
২২. প্রমোদতরী বিনোদন স্পট;
২৩. হাজী মোহাম্মদ হানেশ বিশ্ববিদ্যালয়;
২৪. লিচু বাগান;
দিনাজপুর হচ্ছে পর্যটন নগরী এবং অনেকেই এই জেলাকে কালচারাল সিটি নামে অভিহিত করে থাকে। যেহেতু এখানে রাজা এবং জমিদারদের বসবাস ছিল এবং পরবর্তীতে দিনাজপুর মহকুমা ছিল, তাই এই জেলা তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত। এই জেলার আবাসন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে যাতায়াত ব্যবস্থাসহ সবকিছুই সহজলভ্য এবং হাতের নাগালেই।

দিনাজপুরে ঘুরতে বের হলে এরকম অনেক প্রাচীন নিদর্শনই চোখে পড়ে; Photo © Writer

আবাসন ব্যবস্থা

দিনাজপুরে আবাসন ব্যবস্থার সুবিধা ভালো। সরকারি এবং বেসরকারি দুই পর্যায়েই বেশ ভালো কিছু আবাসন আছে এই জেলাতে।
সরকারি আবাসনসমূহ
০১. দিনাজপুর সার্কিট হাউজ;
০২. পর্যটন মোটেল;
০৩. দিনাজপুর জেলা পরিষদ ডাকবাংলো;
০৪. রামসাগর জাতীয় উদ্যান রেস্ট হাউজ;
০৫. ক্ষণিকা বিশ্রামাগার;
এছাড়াও, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, এলজিইডি, তুলা উন্নয়ন বোর্ড এবং গম গবেষণা কেন্দ্রের গেস্ট হাউজসহ বেশ কিছু সরকারি আবাসন ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য।
বেসরকারি আবাসনসমূহ
০১. কারিতাশ গেস্ট হাউজ;
০২. ব্র্যাক গেস্ট হাউজ;
০৩. পল্লী শ্রী গেস্ট হাউজ;
০৪. এফপিএবি গেস্ট হাউজ;
০৫. পল্লী বিদ্যুৎ রেস্ট হাউজ;
০৬. হোটেল ডায়মন্ড আবাসিক;
০৭. নিউ হোটেল আবাসিক;
০৮. হোটেল সোনার তরী আবাসিক;
০৯. হোটেল আল রশীদ;
১০. হোটেল কণিকা আবাসিক;
দিনাজপুরের লোকজন খুবই মিশুক এবং সমভাবাপন্ন। কোনোভাবেই আপনাকে তারা বুঝতে দেবে না যে, আপনারা বহিরাগত কেউ। আন্তরিক ব্যবহারই তাদের স্বভাবের উপজীব্য বৈশিষ্ট্য। পর্যটন নগরী হওয়াতে এই জেলার মানুষেরা পর্যটকদের যথেষ্ট সম্মান করে। উন্নত জেলা বিধায় যাতায়াত ব্যবস্থাও অতি উন্নত।

Comments