সে বলল, “আমরা আপনেগো কথা জানি মামা, আপনেরা আমাগো কথা জানেন না। রাগ হইয়েন না, আপনেরা খালি নিজেগো সুবিধাডা জানেন”। আমার ফোন আসল, আর কথা হলো না। গন্তব্যে পৌঁছে আমি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ভাড়া দিলাম। তিরিশ টাকা। রিকশাওয়ালা বলল, “ভাড়া পঁয়ত্রিশ মামা”।
আমি বললাম, “সমস্যা কি আপনার? এইখানে আমি প্রত্যেকদিন আসি, ভাড়া এই ত্রিশ টাকাই”।
রিকশাওয়ালা হাসল। বলল, “বলছিলাম না মামা, আপনেগো কথা আমরা জানি, আপনেরা খালি আমাগো কথা জানেন না”। আমার এবার রাগ হল। বললাম, “আপনে ফাইজলামি করেন?” রিকশাওয়ালা নরম গলায় বলল, “না মামা, ফাইজলামি করমু কোন সাহসে? আমাগো অত সাহস নাই। সাহস থাকলে আইজ রিকশা না চালাইয়া আমরাও আন্দোলন করতাম”।
এবার আমি খানিক কৌতূহলী হলাম। কৌতূহলী গলায় বললাম, ‘আন্দোলন করতেন?’
সে বলল, “সরকারি বেতন বাড়ছে না মামা? নতুন বাজেট আইছে না? কি হইছে জানেন? সবার আগে বাড়ছে পিয়াইজের দাম, কাঁচা মরিচের কেজি কত জানেন? দুইশ ট্যাকা, কেরাসিন ৭৫ ট্যাকা, পেঁপে তরকারি খাইতাম আগে ১০ ট্যাকা কেজি, কম দাম এই জন্য প্রত্যেকদিন খাইতাম, এখন পেঁপের কেজি ৩৫ ট্যাকা, যেই ঘরে থাহি, বাড়ীওয়ালা বলছে সবকিছুর দাম বাড়ছে, বাড়িভাড়া বাড়াই দিল। আরও হুনবেন মামা?”
আমি কোন কথা বললাম না। তাকিয়ে রইলাম। রিকশাওয়ালা খানিক থেমে বলল, “এই যে ধরেন ছাত্রগো ভ্যাট বাড়ছে, হ্যারা আন্দোলন করছে, সরকার কিছু একটা করবই। মাস্টারগো বেতন বাড়ে না, আন্দোলন করে কিছু একটা অয়ই। এমুনকি গার্মেন্টসে ঝামেলা? হেরাও আন্দোলন করে, কিছু একটা অয়ই। অয় না?” সে হাসল। হাসতে হাসতেই বলল, “এই যে আপনের কাছে ৫ ট্যাকা বেশি চাইলাম, আপনে কিন্তু খেইপা গেলেন। একবারও ভাবছেন, কাইল যেই ট্যাকা ভাড়া দিছেন, আইজ কি সেই ট্যাকার মূল্য কাইলকের মতন আছে? কিন্তু ৫ ট্যাকার ভাড়া ছয় ট্যাকা চাইছি কি থাপ্পর! হা হা হা।”
মানুষটা হাসছে, কিন্তু তার চোখ ছলছল। সে সেই ছলছল চোখ নিয়ে বলল, “বাসে ভাড়া বাড়াইছে, টেম্পু, সিএনজি সবকিছুতেই বাড়াইছে, খালি রিকশাওয়ালারা বাড়াইতে পারব না। কারণ হ্যারা গ্যাস প্যাট্টোলে রিকশা চালায় না, চালায় শরীলে। গ্যাস পেট্রলের দাম বাড়ছে, রিকশাওয়ালাগো শরীলেরতো আর দাম বাড়ে নাই। বাড়ছে? রিকশাওলার শরীলের আবার দাম কি! হা হা হা! ঠিক না মামা?”
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মানুষটা রিকশা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “হোটেল রেস্টুরেন্টে খাইয়া ১০/২০/১০০ ট্যাকা বখশিশ দেন, খালি রিকশাওয়ালা ২ টা ট্যাকা বেশি চাইলেই আপনেগো মাথায় আগুন উইঠা যায়। আপনেরা এমুন ক্যান মামা? আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, আপনেরা এমুন ক্যান?”
আমি কোন কথা বলি না। বাসায় ফেরার সময় কাঁচা বাজারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। নতুন পে স্কেল হয়েছে। থরে থরে সাজানো সবজির দাম বেড়েছে, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। আমার হঠাৎ মনে হতে থাকে, এই পণ্যগুলোই ওইসব মানুষদের গ্যাস পেট্রোল। এগুলো না হলে ওদের ইঞ্জিন চলবে না। শরীর চলবে না। বন্ধ হয়ে যাবে। এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন আর কিসের? কিসের? হয়তো কোন এক গাঁয়ে কোন ছোট্ট মেয়ে, কোন বৃদ্ধা জীর্ণ মা কিংবা কোন স্ত্রী অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে – এই বুঝি তার রিকশাওয়ালা মানুষটা কটা টাকা পাঠাবে, সেই টাকায় থালায় ভাত উঠবে, পেটে দানা পরবে। আরেকটা সকাল হবে জীবনের।
কিন্তু তারা কি জানে, তাদের পেট নিয়ে ভাববার কেউ নেই। যতটা ভাববার আছি আমরা আমাদের পেট আর ভ্যাট নিয়ে!
Comments
Post a Comment