SaiF UddiN

বাংলাদেশে কালের সাক্ষী হয়ে বিখ্যাত
যে কয়েকটি প্রাচীন স্থাপত্য সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর মধ্যে
অন্যতম সুন্দর নিদর্শন এই কান্তজিউ মন্দির। দিনাজপুর
শহর থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার উত্তরে কাহারোল উপজেলা সদর। সদর থেকে সাত-আট কিলোমিটার
দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নের অবস্থান। দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া
মহাসড়কের পাশে ঢেপা নদীর কোল ঘেঁষে কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে এই মন্দির। মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের
যুদ্ধ বিগ্রহ অধিষ্ঠানের জন্যে।

কান্তজিউ মন্দিরের সম্মুখভাগ;
যদিও
বা এই মন্দির শ্যামগড় এলাকায়,
তবুও এই মন্দিরের কারণেই এই জায়গার নতুন নামকরণ করা হয়
কান্তনগর। তাই এই মন্দিরকে
অনেকে কান্তনগরের মন্দিরও বলে থাকে। আবার, শ্রীকৃষ্ণের জন্য
নির্মিত মন্দির সে অর্থে কান্তজিউ কিংবা কান্তজীর মন্দিরও বলা হয়। তিনতলাবিশিষ্ট এই মন্দিরের নয়টি চূড়া
বা রত্ন ছিল, কেননা
এই মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর ধরন ছিল নবরত্ন স্থাপত্যধারায়। তাই একে নবরত্ন মন্দিরও
বলা হয়।
মন্দিরের
উত্তর দিকে ভিত্তিবেদীর শিলালিপি আছে। প্রখ্যাত
প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া এই শিলালিপি অনুবাদ
করেছিলেন, যাতে
বলা আছে-
প্রাসাদতুল্য
অতিরম্য সুরচিত নবরত্ন দেবালয়ের নির্মাণকার্য নৃপতি প্রাণনাথ আরম্ভ করেন। রুক্মিণীকান্তের (শ্রীকৃষ্ণের)
তুষ্টির জন্য [ও] পিতার সংকল্প সিদ্ধির নিমিত্ত ১৬৭৪ শাকে (১৭৫২ খ্রি.) নৃপতি
রামনাথ কান্তের নিজনগরে (কান্তনগরে) কান্তের (শ্রীকৃষ্ণের) উদ্দেশ্যে এই মন্দির
উৎসর্গ করেন।

মন্দিরের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি;
ভিত্তিবেদীর লিপি অনুযায়ী এবং ইতিহাস
পর্যালোচনা করে জানা যায়, দিনাজপুরের
প্রখ্যাত জমিদার মহারাজা প্রাণনাথ রায় ১৭০৪ সালে এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
করেন। নিজের জীবনের শেষ
দিনগুলোতে মহারাজা প্রাণনাথ রায় মন্দিরের অসমাপ্ত কাজ পূর্ণ করার দায়িত্ব দেন
নিজের দত্তকপুত্র মহারাজ রামনাথ রায়কে। মহারাজ
রামনাথ রায় ১৭২২ সালে আবার নতুনরূপে মন্দিরের কাজ শুরু করেন। ১৭৫২ সালে মূল মন্দিরের কাজ সমাপ্ত হয়।
এই মন্দিরের নির্মাণসামগ্রী নিয়ে
ভিন্ন মত আছে। গঙারামপুর (বর্তমান
দিনাজপুর) এর কাছাকাছি বাননগর নামের এক জায়গায় বিশাল এক প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ থেকে
প্রাপ্ত নির্মাণ উপকরণ দিয়েই এই মন্দিরের নির্মাণকাজ করা হয়। আবার এটাও জানা যায় যে, এই মন্দিরের
নির্মাণকাজের জন্যে ব্যবহৃত পাথর আনা হয়েছিল হিমালয়, বিহারের রাজ মহল
পাহাড় এবং আসামের পার্বত্য অঞ্চল থেকে। তবে
এই মন্দির নির্মাণে কঠিন পাথরের পাশাপাশি ইট, বালি, পোড়ামাটির
টেরাকোটার সংমিশ্রণ যে হয়েছে তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

রাসমেলার সময় মন্দিরে পূজারীদের
ভিড় বাড়ে;
প্রায় ১৮ মিটার বাহুবিশিষ্ট এবং ১ মিটার
উঁচু বর্গাকার বেদীর উপরে মন্দিরটি স্থাপিত। মন্দিরের
একেকটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১৬ মিটার,
যা সম্পূর্ণ ইটের তৈরি। মন্দিরের প্রাঙ্গন আয়তাকার আকৃতির
দেখালেও পাথরের বেদীর উপর দাঁড়ানো এই ত্রিতল ভবনটি ৫০ ফুট উচ্চতার একটি বর্গাকার
ইমারত। তিনতলা এ মন্দিরটি
পিরামিড আকৃতিতে তিন ধাপে উপরের দিকে উঠে গেছে এবং প্রত্যেকটি ধাপেই চূড়া বা রত্ন
ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয়
ধাপে চারটি করে আটটি চূড়া এবং সর্বোচ্চ ধাপে আলাদা একটি চূড়া সবমিলিয়ে নয়টি চূড়া
বা রত্ন কিংবা নবরত্ন।
দেবতা শ্রীকৃষ্ণের পূজার সময়;
এভাবে
মন্দিরের ডিজাইনের কারণ হচ্ছে,
যাতে দূর থেকে মন্দিরটাকে দেখে মনে হয় একটা উঁচু বেদীর উপর
অলংকৃত একটা রথ যাত্রারম্ভ করার জন্যে একদম প্রস্তুত হয়ে আছে। এছাড়া, বেদীর উপর দাঁড়ানো
মূল মন্দিরের চর্তুদিক থেকেই খোলা খিলান পথ রাখা হয়েছে। এতে করে পূজা করতে আসা পূজারীদের সবাই
ভেতরের পবিত্র স্থানে রাখা দেবমূর্তি দেখতে পায়। মূল মন্দিরের নীচতলাতেই গর্ভাগৃহ নামে
অভিহিত ভেতরের রুমে দেবতা শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিটি রাখা আছে।
শুরুতে মন্দিরটি প্রায় ৭০ ফুট উচ্চতার
এবং নয়টি চূড়া বিশিষ্ট হলেও বর্তমানে এটি চূড়াবিহীন তিনতলাবিশিষ্ট ৫০ ফুট উচ্চতায়
দাঁড়িয়ে আছে। এর কারণ দ্য গ্রেট
ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক, যা
১৮৯৭ সালের ১২ জুন আঘাত হেনেছিল। ৮.৭
মাত্রার এই ভূমিকম্প বার্মা,
ভারত,
ভুটান এবং বঙ্গদেশের হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই মারাত্মক ভূমিকম্পেই কান্তজিউ
মন্দিরের নয়টি চূড়া ভেঙে পড়ে। পরবর্তীতে
মহারাজা গিরিজানাথ বাহাদুর অনেক চেষ্টা করেও মন্দিরটিকে সংস্কার করে এর আগের
চেহারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হননি। ফলে
তিনি নয়টি চূড়া বাদেই তিনতলা এই মন্দিরের সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্নির্মাণ করেন।
১৮৭১ সালে ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার জন
হেনরি র্যাভেনশ'র তোলা ছবি;
মন্দিরের প্রার্থনা ঘরের চারদিকেই
চারটি আয়তাকার বারান্দা আছে। নীচতলার
প্রত্যেকটি প্রবেশপথেই আছে অলংকরণে সমৃদ্ধ খাঁজযুক্ত খিলান। খিলানগুলোকে পৃথক করেছে দুটি ইটের
স্তম্ভ, যেগুলো
দৃষ্টিনন্দন অলংকরণে সমৃদ্ধ। নীচতলায়
মোট ২১টি খিলান দরজা আছে চার প্রকোষ্ঠের বাইরে, দোতলায় আছে ২৭টি; কিন্তু তৃতীয়তলা
ক্রমশ ছোট হয়ে এসেছে বলে এখানে আছে কেবল ৩টি দরজা।
মন্দিরের পশ্চিমদিকে দ্বিতীয়
বারান্দায় একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন সংকীর্ণ অথচ প্রশস্ত একটি সিড়ি আছে, যা এঁকেবেঁকে ধাপে
ধাপে তিনতলায় উঠে শেষ হয়েছে। নীচতলার
ছাদের বাঁকা কার্নিশ একদম কোণগুলোতে এসে ঝুলে গেছে। দোতলার কারুকার্যখচিত অষ্টকোণাকৃতির
বুরুজগুলোর ভর বহন করে আছে নীচতলার প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠ। এভাবে আলাদা প্রকোষ্ঠ দিয়ে ভিত্তিকে
শক্তিশালী করে তোলার কারণে মূল কাঠামো সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।
কান্তজিউ মন্দিরের ডান পাশ;
কান্তজিউ মন্দির দূর থেকে যেমন দেখে
অলংকৃত রথের সৌন্দর্যের দেখা মেলে, ঠিক তেমনি কাছে এলে পোড়ামাটির
টেরাকোটায় মুগ্ধতা আরো বাড়ে। পুরো
মন্দির জুড়ে প্রায় ১৫,০০০
কিংবা তারও বেশি টেরাকোটা আছে। বাংলাদেশের
অন্যান্য যত প্রাচীন নিদর্শন আছে,
সেগুলোর টেরাকোটায় বিষয়বস্তুর এত বৈচিত্র্য কিংবা এত বিশাল
পরিমাণের টেরাকোটা লক্ষ্যণীয় নয়। মন্দিরের
প্রতিটি ইঞ্চিতে পোড়ামাটির এসব টেরাকোটা মন্দিরের সৌন্দর্য বিকাশের পাশাপাশি তিনটি
পৌরাণিক কাহিনীচিত্র বর্ণনা করে।
রামায়ণ, মহাভারত এবং
শ্রীকৃষ্ণের উপাখ্যান দিয়ে সজ্জিত হয়েছে এসব পোড়ামাটির ফলক। মন্দিরের চারটি দেয়ালে চারটি আলাদা
শাস্ত্রীয় যুগের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে এসব টেরাকোটায়। যুগগুলো হচ্ছে- সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি। শুধু পৌরাণিক কাহিনীই নয়, বরং মুঘল বাদশাহদের
কর্মকান্ড, তৎকালীন
সমাজ জীবনের বাস্তব চিত্র এবং জমিদার কিংবা অভিজাত বংশীয় সমাজ ব্যবস্থা স্পষ্ট
প্রতিফলন হয়েছে এসব টেরাকোটায়। পোড়ামাটির
এসব শিল্প অত্যন্ত দারুণভাবে ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে। এই মন্দিরের শৈল্পিক বিষয়বস্তুর
বৈচিত্র্যে মুগ্ধ আর বিস্মিত হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।

মন্দিরের টেরাকোটা;
আরো জানার বিষয় হচ্ছে, মন্দিরের যেমন
তিনটি ধাপ, ঠিক
তেমনি পোড়ামাটির এসব টেরাকোটাতেও তিনটি ধাপেই এর বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। মন্দিরের ভিত্তিমূলের একদম নিম্নাংশের
সাধারণ চিত্রাবলী এমনভাবে বসানো হয়েছে যে, ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সবগুলো চিত্রই
সমান্তরালভাবে চারটি আলাদা প্রবেশপথের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব চিত্রের ঠিক উপরেই আছে লতাপাতার
মধ্যে প্রস্ফুটিত গোলাপ কিংবা গোলাপের বিকল্প হিসেবে চারটি ধাতুর পাতের ডিজাইন, যা প্রস্ফুটিত
গোলাপের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
স্তম্ভগুলোর কার্নিশগুলোতে তৎকালীন
সমাজ জীবনের বাস্তব চিত্র এবং টেরাকোটাতে রাজা বা জমিদার কিংবা অভিজাত শ্রেণীর
সদস্যদের শিকার করার দৃশ্য। শিকারের
দৃশ্যের ঠিক উপরেই যে সমান্তরাল অংশ আছে, সেখানেও প্রস্ফুটিত গোলাপই দৃশ্যায়িত
হয়েছে, তবে
সেটা আগেরটার মতো নয়। এটা
সূক্ষ্ম, জটিল
এবং অনেকটা জ্যামিতিক আদলে করা হয়েছে, যেগুলো সাধারণত বাংলাদেশের অন্যান্য
প্রাচীন নিদর্শন, বিশেষ
করে প্রাচীন মসজিদগুলোতে দেখা যায়।
দ্বিতীয় ধাপে বনের ভেতরে শিকারের
দৃশ্য এবং রাজকীয় শোভাযাত্রার দৃশ্য রয়েছে। শোভাযাত্রাসমূহতে
সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, উট এবং অত্যন্ত
সুন্দরভাবে সজ্জিত গরুর গাড়িও চোখে পড়ে। তাদের
গায়ের পোশাক-আশাক এবং অস্ত্রসমূহ দেখতে অনেকটাই মোঘল আমলের। দ্বিতীয় ধাপের কোথাও কোথাও আবার
সুন্দরভাবে সজ্জিত পালকিতে বসে হুক্কা টেনে ধোঁয়া ছাড়ার দৃশ্য, নদীর তীরের
মানুষজনের দৃশ্য কিংবা নদীতে সরু নৌকায় চড়ে সকলের আন্দোৎসবের দৃশ্য দেখা যায়।
তৃতীয় ধাপ, অর্থাৎ টেরাকোটার
শেষ ধাপে বর্ণিত হয়েছে পৌরাণিক কাহিনী। লৌকিক
দৃষ্টিতে কৃষ্ণের প্রতিকৃতি দেখানো হয়েছে। লম্বা, সরু নৌকায় করে
কৃষ্ণের আনন্দভ্রমণ ছাড়াও তাঁর রাক্ষস পাতনা বধ, সারস গলার দানব
বকাসুর বধ, সর্পদানব
কালিয়াক এবং কেশি হত্যা; এসব
পৌরাণিক চিত্র সূক্ষ্মভাবে দৃশ্যায়িত হয়েছে। রামায়নের
দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে মন্দিরের পূর্বপ্রান্তের সীমানা পর্যন্ত। পঞ্চবটীর বনে রাম, সীতা এবং লক্ষণের
বনবাস, আবার
রাবনের দাণ্ডকের বন থেকে সীতাকে অপহরণ, অশোক বনে সীতার বন্দিদশার জীবনযাপন সহ
আরো পৌরাণিক কাহিনীচিত্র বর্ণিত হয়েছে এসব পোড়ামাটির ফলকে।
মন্দিরের টেরাকোটায় বর্ণিত হয়েছে
পৌরাণিক ইতিহাস;
কৃষ্ণ বলরামের আধিপত্য বিস্তার লক্ষ্য
করা গেছে উত্তরদিকে। সেগুলোর
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিভিন্ন সময়ের কৃষ্ণের বিয়ের দৃশ্য ও গোয়ালিনীর শিকায় করে
দুধ আর দই বয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। পশ্চিমদিকে
দৃশ্যায়িত হয়েছে কংস রাজার দানবীয় খুনে হাতির ধ্বংসলীলা সহ বিভিন্ন সময়ের যুদ্ধের
ইতিহাস চিত্র। এছাড়াও, বৃত্তের মধ্যে
নৃত্যরত কৃষ্ণ আর রাধা, কুরু
এবং লঙ্কার যুদ্ধের কাল্পনিক চিত্রাবলীও বর্ণিত হয়েছে এসব টেরাকোটায়। এই মন্দিরের পোড়ামাটির ফলকের
টেরাকোটার সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে দেবতাদের কামুক চরিত্রকে উপেক্ষা করে
মানবিক চরিত্র দেখানো হয়েছে।
কান্তজিউ মন্দিরে শুধুমাত্র কৃষ্ণের
পূজাই হয় না, বরং
শিবের পূজাও হয়। মূল মন্দিরের পাশেই
একটি ছোট শিব মন্দির আছে। মূল
মন্দিরের চারপাশে পূজারীদের বসার জন্য নির্ধারিত স্থান আছে এবং সেগুলো চারদিক থেকে
টিন দিয়ে সুরক্ষিতভাবে ঢাকা। মূল
মন্দির থেকে সামান্য দূরেই আছে কান্তজিউ রাসবেদী। মূল মন্দিরের বাইরের পথ থেকে হাতের
ডানে আনুমানিক ৫০-৬০ গজ এগিয়ে গেলেই আগাছায় ভরা ধ্বংসপ্রাপ্ত এক চূড়া বিশিষ্ট
অনেকটা ডোম আকৃতির মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে।
পরিত্যক্ত দেবালয়;
জনশ্রুতি আছে, একবার
সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে রাজা প্রাণনাথকে জোরপূর্বক জমিদারীর অভিযোগে দায়ী করে
দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয়। ফেরার
পথে বৃন্দাবনের ধারে যমুনার জলে স্নানকালে তিনি কালো পাথরের একটি কৃষ্ণ মূর্তি পান। সে রাতেই তিনি স্বপ্নে দেখেন, নৌকায়
করে নিজ রাজ্যে ফেরার পথে যেখানে নৌকা আপনা আপনি থেমে যাবে সেখানেই একটি মন্দির গড়ে
এই মূর্তি স্থাপন করা লাগবে।
পরবর্তীতে তিনি এখানে এই মন্দিরটি
স্থাপন করেন ১৭০৪ সালে, যা
মূলত কান্তজিউ মন্দিরের সূচনা ছিল এবং পরবর্তীতে তার শেষ ইচ্ছায় নির্মিত নবরত্ন
মন্দিরে সেই মূর্তিটি স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে
এটি একটি পরিত্যক্ত দেবালয়। এই
মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট এবং চর্তুদিক থেকে মোট ১৬ পাশ সৌধ নির্মিত এই
মন্দিরের প্রবেশ পথে খুব সম্ভবত একই ভঙ্গীর বহু খাঁজ বিশিষ্ট খিলান দরজা ছিল।

রাসলীলা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের লীলার
মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় এক লীলা। নির্মাণকালীন
অর্থাৎ ১৭৫২ সাল থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিবছরই রাসমেলার আয়োজন করা হয় এই মন্দিরে। পৌরাণিক ইতিহাস বলে, শ্রীকৃষ্ণ তার
গোপীদের নিয়ে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথির রাতে বৃন্দাবনের রাস উৎসবে মেতে উঠতেন। তাই, শ্রীকৃষ্ণের জন্য
নির্মিত এই মন্দিরের জন্মলগ্ন থেকেই রাসমেলা হয়ে আসছে, যা চলে পুরো
মাসব্যাপী। বলা যায়, রাসমেলাও এই
মন্দিরের মতোই ঐতিহ্য সমৃদ্ধ।
মাসব্যাপী রাসমেলায় মন্দির
প্রাঙ্গন জুড়ে হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা;
বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক এবং
ঐতিহাসিক ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিল্টন এই মন্দিরের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন,
সমগ্র
বাংলা জুড়ে এত সুন্দর মন্দির আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। এই মন্দিরের নান্দনিক সৌন্দর্য, স্থাপত্যশৈলীর
প্রাচুর্য এবং এর শ্রেষ্ঠত্বের সাথে অন্য কোনো স্থাপত্যের তুলনা হয় না।
১৮৭১ সালে ভারত উপমহাদেশ ভ্রমণে এসে
বিখ্যাত ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার জন হেনরি র্যাভেনশ কান্তজিউ মন্দিরের কিছু ছবি তোলেন, যা বর্তমানে
ব্রিটিশ লাইব্ররিতে সংরক্ষিত আছে। এই
ছবিগুলোতে মন্দিরের প্রাচীন সৌন্দর্য আরো স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। একটি ছবিতে সম্পূর্ণ মন্দিরের নয়টি
চূড়াই লক্ষ্যণীয়।


যদিও
বর্তমানে মন্দিরটি রাজ দেবোত্তের স্টেটের নিয়ন্ত্রণে, তবে সার্বিক
দেখাশোনার দায়িত্বে সহযোগিতা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ। মন্দিরের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে
বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে সহায়তা করে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এছাড়াও, দক্ষিণ
এশিয়া ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় প্রত্নতত্ত্ব
অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে এর সার্বিক তত্ত্বাবধানের কাজ হয়ে থাকে।
Comments
Post a Comment