বাইক্কা বিলঃ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পাখির অভয়াশ্রম

SaiF UddiN

বেশ কয়েক মাস ঘুরে এলাম বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পাখির অভয়াশ্রম মৌলভিবাজার জেলার অন্তর্গত শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলে। শীতের প্রচন্ড তীব্রতায় একটু উষ্ণতা পেতে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পরদেশী পাখিরা এসে ভিড় করে শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের এই বিলে। শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যবাহী সুবিশাল হাইল হাওরের ‘বাইক্কা বিল’ না দেখলে শ্রীমঙ্গলের কিছুই যেন দেখা হলো না। পাখির এ কলকাকলি উপভোগ করার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসে এখানে। সুদূর উত্তর আমেরিকা, সাইবেরিয়া ও হিমালয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখিরা এসে ভিড় করে বাইক্কা বিলে। হাজারও পাখির উপস্থিতি ও কলতানে মুখরিত হয়ে বাইক্কা বিল যেন এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। বর্তমান হাইল হাওরের প্রাণ বাইক্কা বিল। ‘ইউএসএইড’ এর অর্থায়নে মার্চ প্রকল্পের মাধ্যমে বাইক্কা বিলে গড়ে তোলা হয়েছে মৎস্য ও পাখির স্থায়ী অভয়াশ্রম। বর্তমানে বাইক্কা বিলটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে সমন্বিত রক্ষিত এলাকা সহ-ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইপ্যাক)।

বাইক্কা বিলের ঢোকার পথে; Source: wli.wwt.org.uk
বাইক্কা বিলে মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলায় দেশের বিলুপ্তপ্রায় রুই, গইন্না, কালিবাউস, দেশী সরপুটি, পাবদা, আইড়, গুলশা, চিতলসহ ১৫/২০ প্রজাতির মাছ বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। পানিপূর্ণ বাইক্কা বিলের সাথে আমরা অনেকেই হয়তো পরিচিত নই। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন থৈ থৈ করা পানির বাইক্কা বিলের সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত হই।

পড়ন্ত এক বিকেলে বাইক্কার বিলে, ছবি মুসরাত যাহান
এখানে নানা জাতের মাছের সঙ্গে আরও রয়েছে বিলের কিনারে ফোটে হাজারো পানা, শাপলা আর পদ্মফুল। বিলের পানিতে সকাল-সন্ধ্যা চলে রঙ্গীন ফড়িংয়ের বিরতিহীন উড়াউড়ি। বৃষ্টিহীন উষ্ণ দিনে বিলের ফুলের পাশে আসে আরো একদল পতঙ্গ। প্রকৃতিপ্রেমীর চোখে পাখিই এই অভয়াশ্রমের সেরা প্রাণী। শীত মৌসুমে এখানে আসে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি। এই বিলের উল্লেখযোগ্য পাখি- পানকৌড়ি, কানিবক, ধলাবক, গোবক, ধুপনিবক, রাঙ্গাবক, দলপিপি, নেউপিপি, পান মুরগি, বেগুনি কালেম, কালোমাথা কাস্তেচরা, শঙ্খ চিল, পালাসী কুড়া ঈগল। শীতের অতিথি হয়ে এই বিলে আসে অনেক জাতের সৈকত পাখি। এদের মধ্যে আছে গেওয়ালা বাটান, মেটেমাথা চিটি আর কালাপঙ্খ ঠেঙ্গী, ধলা বালিহাঁস, পাতি সরালী, রাজসরালী, মরচেরং, ভূতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঙ্গাহাঁস, গুটি ঈগল, সাপ-ব্যাঙ এবং আরও নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ।

অনেক নাম না জানা পাখির দেখা পাওয়া যায় এখানে, ছবি: poriborton.com
তবে পানিপূর্ণ বাইক্কা বিলে যাওয়া খুব কষ্টের। রাস্তার দুর্ভোগ মনে রাখার মতো! আমরা গিয়েছিলাম প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে। যেতে যেতে পথে অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছিলো। এর মধ্যে ঠিকমতো চেনা নেই জায়গাটি। তাই যাকে দেখি, তাঁকেই জিজ্ঞেস করি, “চাচা, বাইক্কা বিল কত দূর?” “এইতো সামনে…।” এই সামনে আর যেন শেষ হয় না। কিছু সময় পর আমরা এত অসাধারণ দৃশ্য দেখি যে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই ছিলাম!
বামে সবুজে ঘেরা পানি, ডানেও পানি। কিন্তু মাঝে সরু রাস্তা। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা আসলেও দুরূহ। কিছু দূর গেলেই এখানে দেখা মিলবে বড় শিংওয়ালা ষাঁড়ের। তাঁদের হাঁটার ভঙ্গী দেখলে মনে হবে এই রাস্তা তাঁদের জন্যই বানানো। এরা এমন কোমর দুলিয়ে হাঁটে যে বোঝা মুশকিল ডানে যাবো নাকি বামে। কাঁচা রাস্তা হওয়াতে অনেক দুর্ভোগেও পড়তে হয়েছিল আমাদের। কাঁদামাটিতে যখন গাড়ির চাকা আটকে যায়, তখন দু’পাশে শুধু পানি টলমল করছিলো। বাধ্য হয়ে আমরা নেমে পড়ি গাড়ি ধাক্কা দিতে। জীবনে অনেক কিছুরই অভিজ্ঞতা থাকতে হয়, তাই হয়ে গেলো এই অভিজ্ঞতাটিও। বিপদে পড়লে বুদ্ধি বাড়ে বলে একটা কথা আছে। সবচাইতে চমৎকার বিষয় হচ্ছে এখানকার মানুষগুলো অনেক বেশী ভালো।
বেশ কিছুক্ষণ পর একটি সিএনজির দেখা মিললো। আমাদের অসহায় অবস্থায় দেখে সিএনজির যাত্রীরা নেমে পড়ে আমাদের সাহায্য করতে। গাড়ি কোনোমতে একটি নিরাপদ স্থানে রেখে পায়ে হাঁটা শুরু করি দিই আমরা। সে এক লম্বা পথ। মাটির পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিলের মাছগুলো ছুটোছুটি করতে করতে পানির উপর মুখ উচিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে। বিলের জলে পানকৌড়ি, ছোট সরালি আর পাতিহাঁসের ডুব দেয়ার দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবেই। তবে বিলে অনেক সাপ রয়েছে, তাই একটু সাবধান হয়েই হাঁটা উচিৎ। পানিপূর্ণ বাইক্কা বিলের চারিদিকে শুধুই পানি আর পানি।

পানির উপর এক্কা দক্কা খেলা, ছবিঃ thedhakatimes.com
আমাদের পৌঁছতে পৌঁছতে শেষ বিকেলের আলো পড়ে যায়। তখন বিলের পাখিগুলো এক ঝাঁকে নীড়ে ফিরছিলো। আগে শুধুমাত্র শীতকালে হাইল হাওরে পাখি দেখা যেত। কিন্তু পাখির স্থায়ী অভয়াশ্রম হবার কারণে পুরো বছরই পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে বাইক্কা বিল। পর্যটকদের সুবিধার্থে পাখি দেখার জন্য বাইক্কা বিলে পানির উপরে তৈরী করা হয়েছে তিন তলা বিশিষ্ট একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বিলের পাখিদের কাছ থেকে দেখার জন্য রয়েছে সুব্যবস্থা। ইচ্ছে করলে আপনি স্বল্পমূল্যে বিলে নৌকাভ্রমণ করতে পারেন। আমরা নৌকাতে চড়তে পারিনি কারণ সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। প্রচন্ড গরমের সময় পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের উপরে বসলে হিমশীতল বাতাস আপনার শরীরে ঠান্ডার কাঁপন তুলবে মুহুর্তেই। বাইক্কা বিলের ওয়াচ টাওয়ারের উপর বসে আমরা সূর্য ডোবা দেখি।

অস্বাভাবিক সুন্দর এই বিল; ছবি – মুসরাত যাহান
বাইক্কার বিলের সূর্যাস্তটা অনেক সুন্দর। কী সুন্দর করে সূর্যটা আস্তে আস্তে টুপ করে পানির মধ্যে পড়ে যায়। এক কথায় মধুর ছিল সে মুহূর্ত। বাইক্কা বিল একদম প্রকৃতির ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। একবার ঢুকে গেলে আর বের হতে ইচ্ছে করবে না। প্রকৃতি প্রেমিক এবং পাখির ছবি তুলতে যারা ভালোবাসে, তাদের বাইক্কা বিল আসতেই হবে। কারণ এখানে এমন সব পাখির দেখা মিলবে যা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।

সূর্য যখন পানির মধ্যে ধীরে তলিয়ে যায়; ছবি- মুসরাত যাহান
এছাড়া বাইক্কা বিলে পাওয়া যায় সুস্বাদু মাখনা, শালুকসহ নানা স্বাদের, নানা বর্ণের জলজ ফল। বিলের পানিতে ফুটে থাকা পদ্ম, শাপলা প্রভৃতি জলজ ফুল আপনার মনে নাড়া দেবে। বাইক্কা বিলে যেতে হলে শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার সড়ক ধরে কালাপুর বাজার থেকে একটু সামনে এগুলেই বরুনা-হাজীপুর পাকা রাস্তার দেখা মিলবে। এ রাস্তায় প্রবেশ করে যেতে হবে হাজীপুর বাজারে। স্থানীয়দের কাছে এ বাজারটি ঘাটের বাজার নামে পরিচিত। সেখান থেকে মোটর সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে প্রায় ৩/৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাইক্কা বিল। কিন্তু আমরা যেহেতু গাড়ি দিয়ে গিয়েছি, তাই আমাদের অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। গাড়ি দিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। হাজীপুর বাজারে বেশ ক’জন গাইড রয়েছে। আপনি চাইলে গাইডের সাহায্যও নিতে পারেন। গাইড আপনাকে পুরো বাইক্কা বিল দেখতে সাহায্য করবে। আমরা গাইড নেই নি। আশেপাশে মানুষদের জিজ্ঞেস করলেও আপনি আপনার গন্তব্যস্থলে যেতে পারবেন। তবে অবশ্যই সঙ্গে বেশি মানুষ নিয়ে যাবেন।

খুব করে মনে ধরবে বাইক্কার বিলের প্রতিটি মুহূর্ত; ছবি- মুসরাত যাহান
বাইক্কা বিল একেক ঋতুতে একেক রূপ ধারণ করে। সব ঋতুতেই সুন্দর এই হাইল হাওরে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় ভ্রমণের জন্য সেরা। এ সময় এখানটা প্রচুর সংখ্যক পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে। লোকমুখে শুনেছি, যত শীত ততো পাখি! জলজ উদ্ভিদ, মাছপ্রেমীদের জন্য এটা সেরা মৌসুম। যেহেতু অনেকটা দূর হেঁটেই যেতে হয়, তাই সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি আর শুকনা খাবার নিয়ে গেলে ভালো।
হ্যাপি ভ্রমণিং!

Comments