ঘরভর্তি সব মোমবাতিগুলো জ্বালানো শেষ করতে করতে বেশ কয়েকটা পুড়ে শেষও হয়ে গেছে। ওখানে কয়েকটা নতুন মোমবাতি দিলে ভালো হতো, কিন্তু একটা মোমবাতিও আর অবশিষ্ট নেই। ঠিক ঘরের মাঝখানে একটা বড় রঙিন মোমবাতি আপন দীপ্তিতে জ্বলে যাচ্ছে। বর্ণালীর চোখের কোণে আটকে থাকা জলে মোববাতির আলো পরে চিক চিক করছে।
.
আজ ঋতের প্রথম জন্মদিন। ঋত, বর্ণালীর একমাত্র সন্তান। যদিও ঋতের নামটা বর্ণালীর বিয়ের আগে থেকেই ঠিক করা।
যখন সৌমিককে ভালোবাসতো তখন একদিন হঠাৎ করেই সৌমিককে জিজ্ঞেস করে-আচ্ছা, আমাকে দুটো নাম বলে দেবে? একটা ছেলের নাম আর একটা মেয়ের।
"হঠাৎ নাম দিয়ে কি হবে?"
-তোমার দেয়া নামেই আমার প্রথম সন্তানের নাম রাখবো।
.
কথাটা শুনে সৌমিক কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো বর্ণালীর দিকে। বর্ণালীর মলিন মুখ আর চোখের বাঁধ চুই-চুই জলের সামনে এইটুকু আবদার না রাখার মত নির্দয় সেদিন হতে পারেনি। অনেক ভেবে সেদিনই দুটো নাম ঠিক করে দেয়। একটা 'ঋত', অন্যটা 'জয়ীতা'। বর্ণালী সেদিন থেকেই ঠিক করে রেখেছিলো, তার প্রথম সন্তান ছেলে হলে নাম রাখবে ঋত, আর মেয়ে হলে-জয়ীতা।
.
সৌমিকটা কি বর্ণালীকে কখনোই বুঝতে পারেনী, নাকি বুঝেও নিশ্চুপ ছিলো-ব্যাপারটা বর্ণালীর কাছে এখনও ধোঁয়াশা। সৌমিক ছিলো বর্ণালীর এক বৌদির মাসতুতো ভাই। দাদার বিয়েতেই পরিচয়। এর পর মাঝে মাঝেই কথা হতো, ফোনে। আস্তে আস্তে কখন যে ছেলেটাকে ভালো লেগেযায় নিজেও বুঝতে পারেনী। হয়তো সৌমিকও ওকে....। না! না! সৌমিক কখনও ওকে ভালোবাসেনী; অন্তত বর্ণালীর এটাই ধারনা। ঠিক ধারনাও নয়, বিশ্বাস। বিশ্বাস করারও যথেষ্ট যুক্তি আছে বৈকি। ভালোবাসলে কি ভালোবাসার মানুষকে কেউ নিজে পাত্র দেখে বিয়ে দিতে পারে!
.
খুব বেশীদিন হয়নি, এইতো আড়াই বছর আগে। বর্ণালী তখন সবে ক্লাশ টেনে। আচমকা বর্ণালীর বাবা মারা গেলে সমস্ত পরিবারের উপর অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে। পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়ে বর্ণালী আর ওর দেড় বছরের ছোট ভাইকে নিয়ে ওর মা যেন আচমকা নৌকাডুবিতে গভীর সমুদ্রে পরে যায়, চারদিকে সাতরেও যখন কূল পাচ্ছিলো না ঠিক তখনই পাশে দাড়ায় সৌমিক। একদিন বর্ণালীর মা সৌমিককে সব কিছু খুলে বলে।
.
বর্ণালীর বাবা মিত্যুর আগে কিছু টাকা রেখে গেছেন। অনেকে বলছেন টাকাগুলো দিয়ে ছেলেটাকে একটা দোকান দিয়ে দিতে। কিন্তু সব টাকা ভেঙে ফেললে মেয়ের বিয়ে কি করে দেবেন তিনি? তাই সৌমিকের উপরেই দ্বায়িত্ব পরে ভাল একটা পাত্র দেখার।
.
একটা ভালো ছেলে খুঁজে বের করতে খুব বেশীদিন লাগেনী সৌমিকের। ছেলে শিক্ষিত, স্বর্ণকার, ভালো ঘর। বর্ণালী ভালোই থাকবে। যথেষ্ট শুশ্রী বর্ণালীকেও তাদের পছন্দ না করার কোন কারন ছিলো না। কোন পণ ছাড়াই বিয়েটা হয়ে গেল। কিন্তু সেই বিয়েতে ছিলো না সৌমিক। হয়তো বর্ণালীর সামনে দাড়াতে পারবে না বলে!
.
সেদিন বর্ণালীর মায়ের অশ্রুসজল কষ্টগাথা শুনতে শুনতে বর্ণালীর মাকে বর্ণালীর বিয়ে ঠিক করে দেয়ার কথা দেয়ার সময় কি সৌমিকের বুক একটুও কাঁপেনী?
.
আজ ঋতের প্রথম জন্মদিন। ঋত, বর্ণালীর একমাত্র সন্তান। যদিও ঋতের নামটা বর্ণালীর বিয়ের আগে থেকেই ঠিক করা।
যখন সৌমিককে ভালোবাসতো তখন একদিন হঠাৎ করেই সৌমিককে জিজ্ঞেস করে-আচ্ছা, আমাকে দুটো নাম বলে দেবে? একটা ছেলের নাম আর একটা মেয়ের।
"হঠাৎ নাম দিয়ে কি হবে?"
-তোমার দেয়া নামেই আমার প্রথম সন্তানের নাম রাখবো।
.
কথাটা শুনে সৌমিক কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো বর্ণালীর দিকে। বর্ণালীর মলিন মুখ আর চোখের বাঁধ চুই-চুই জলের সামনে এইটুকু আবদার না রাখার মত নির্দয় সেদিন হতে পারেনি। অনেক ভেবে সেদিনই দুটো নাম ঠিক করে দেয়। একটা 'ঋত', অন্যটা 'জয়ীতা'। বর্ণালী সেদিন থেকেই ঠিক করে রেখেছিলো, তার প্রথম সন্তান ছেলে হলে নাম রাখবে ঋত, আর মেয়ে হলে-জয়ীতা।
.
সৌমিকটা কি বর্ণালীকে কখনোই বুঝতে পারেনী, নাকি বুঝেও নিশ্চুপ ছিলো-ব্যাপারটা বর্ণালীর কাছে এখনও ধোঁয়াশা। সৌমিক ছিলো বর্ণালীর এক বৌদির মাসতুতো ভাই। দাদার বিয়েতেই পরিচয়। এর পর মাঝে মাঝেই কথা হতো, ফোনে। আস্তে আস্তে কখন যে ছেলেটাকে ভালো লেগেযায় নিজেও বুঝতে পারেনী। হয়তো সৌমিকও ওকে....। না! না! সৌমিক কখনও ওকে ভালোবাসেনী; অন্তত বর্ণালীর এটাই ধারনা। ঠিক ধারনাও নয়, বিশ্বাস। বিশ্বাস করারও যথেষ্ট যুক্তি আছে বৈকি। ভালোবাসলে কি ভালোবাসার মানুষকে কেউ নিজে পাত্র দেখে বিয়ে দিতে পারে!
.
খুব বেশীদিন হয়নি, এইতো আড়াই বছর আগে। বর্ণালী তখন সবে ক্লাশ টেনে। আচমকা বর্ণালীর বাবা মারা গেলে সমস্ত পরিবারের উপর অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে। পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়ে বর্ণালী আর ওর দেড় বছরের ছোট ভাইকে নিয়ে ওর মা যেন আচমকা নৌকাডুবিতে গভীর সমুদ্রে পরে যায়, চারদিকে সাতরেও যখন কূল পাচ্ছিলো না ঠিক তখনই পাশে দাড়ায় সৌমিক। একদিন বর্ণালীর মা সৌমিককে সব কিছু খুলে বলে।
.
বর্ণালীর বাবা মিত্যুর আগে কিছু টাকা রেখে গেছেন। অনেকে বলছেন টাকাগুলো দিয়ে ছেলেটাকে একটা দোকান দিয়ে দিতে। কিন্তু সব টাকা ভেঙে ফেললে মেয়ের বিয়ে কি করে দেবেন তিনি? তাই সৌমিকের উপরেই দ্বায়িত্ব পরে ভাল একটা পাত্র দেখার।
.
একটা ভালো ছেলে খুঁজে বের করতে খুব বেশীদিন লাগেনী সৌমিকের। ছেলে শিক্ষিত, স্বর্ণকার, ভালো ঘর। বর্ণালী ভালোই থাকবে। যথেষ্ট শুশ্রী বর্ণালীকেও তাদের পছন্দ না করার কোন কারন ছিলো না। কোন পণ ছাড়াই বিয়েটা হয়ে গেল। কিন্তু সেই বিয়েতে ছিলো না সৌমিক। হয়তো বর্ণালীর সামনে দাড়াতে পারবে না বলে!
.
সেদিন বর্ণালীর মায়ের অশ্রুসজল কষ্টগাথা শুনতে শুনতে বর্ণালীর মাকে বর্ণালীর বিয়ে ঠিক করে দেয়ার কথা দেয়ার সময় কি সৌমিকের বুক একটুও কাঁপেনী?
হয়তো কেঁপেছিলো! সেই কম্পনে হয়তো সৌমিকের হৃদয়েও ধ্বংসস্তুপ হয়েছিলো, কিন্তু কেউ টের পায়নি।
.
আজ মা দিবস। ঋতের জন্মদিনও আজ। আজতো একটি মায়েরও প্রথম জন্মদিন!
বেশ কিছুক্ষন নিশ্চুপ থাকার পর হঠাৎ নিজের মাথার চুলে এক হাত গুঁজে উচ্চস্বরে গেয়ে উঠলো-হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থ ডে টু ঋত! আচমকা আবার নিস্তব্দ হয়ে গেল সবকিছু! কিছুক্ষন পরে আবার অট্টহাসি!
.
বিয়ের কিছুদিনের মাথায়ই বর্ণালীর স্বামী একটা ওষুধ কম্পানীতে চাকরি পায়। বাবার স্বর্ণকারের দোকানের ভার ছোট ভাইকে দিয়ে বর্ণলীকে নিয়ে কর্মস্থল ঝিনাইদহে নতুন বাসায় ওঠে।
.
বেশ ভালোই চলছিলো ওদের সংসার। ওর স্বামী কখনও ভালোবাসায় কমতি করেনি ওকে। বিয়ের মাস সাতেকের মাথায় ঋতের আসার সুসংবাদটা সেই আনন্দে আরও নতুন মাত্রা যোগ করে। বর্ণালী চেষ্টা করেছিলো সৌমিককে সুখবরটা দিতে, কিন্তু সৌমিক কখনোই আর ওর সামনে দাড়ায়নি। বাধ্য হয়ে ফেইসবুকে ছোট্ট করে একটা ম্যাসেজ দিলেও সেই ম্যাসেজের রিপ্লাই আজও আসেনি।
.
ঘরের মধ্যে আবার উচ্চহাসির শব্দ আর হ্যাপি বার্থডের গান শুনে বিছানায় শুয়ে থাকা বর্ণালীর অসুস্থ মা-ও এসে বর্ণালীর ঘরের দরজায় দাড়ায়। তার দুচোখ গড়িয়েও অঝোরে ঝরছে অশ্রু-ঝর্ণা। এক মায়ের কষ্ট একমাত্র মায়েরা ছাড়া আর কে-ই বা বুজবে? আর তিনিও তো একজন মা। তিনি ওর কষ্টটা খুব ভালোভাবে বুঝলেও এই কষ্টে শান্তনা দেয়ার কোন ভাষা আজ তার কাছে নেই। দরজার পাশে দাড়িয়ে মোমবাতির দিকে তাকিয়ে নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন তিনিও!
.
আজ মা দিবস। ঋতের জন্মদিনও আজ। আজতো একটি মায়েরও প্রথম জন্মদিন!
বেশ কিছুক্ষন নিশ্চুপ থাকার পর হঠাৎ নিজের মাথার চুলে এক হাত গুঁজে উচ্চস্বরে গেয়ে উঠলো-হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থ ডে টু ঋত! আচমকা আবার নিস্তব্দ হয়ে গেল সবকিছু! কিছুক্ষন পরে আবার অট্টহাসি!
.
বিয়ের কিছুদিনের মাথায়ই বর্ণালীর স্বামী একটা ওষুধ কম্পানীতে চাকরি পায়। বাবার স্বর্ণকারের দোকানের ভার ছোট ভাইকে দিয়ে বর্ণলীকে নিয়ে কর্মস্থল ঝিনাইদহে নতুন বাসায় ওঠে।
.
বেশ ভালোই চলছিলো ওদের সংসার। ওর স্বামী কখনও ভালোবাসায় কমতি করেনি ওকে। বিয়ের মাস সাতেকের মাথায় ঋতের আসার সুসংবাদটা সেই আনন্দে আরও নতুন মাত্রা যোগ করে। বর্ণালী চেষ্টা করেছিলো সৌমিককে সুখবরটা দিতে, কিন্তু সৌমিক কখনোই আর ওর সামনে দাড়ায়নি। বাধ্য হয়ে ফেইসবুকে ছোট্ট করে একটা ম্যাসেজ দিলেও সেই ম্যাসেজের রিপ্লাই আজও আসেনি।
.
ঘরের মধ্যে আবার উচ্চহাসির শব্দ আর হ্যাপি বার্থডের গান শুনে বিছানায় শুয়ে থাকা বর্ণালীর অসুস্থ মা-ও এসে বর্ণালীর ঘরের দরজায় দাড়ায়। তার দুচোখ গড়িয়েও অঝোরে ঝরছে অশ্রু-ঝর্ণা। এক মায়ের কষ্ট একমাত্র মায়েরা ছাড়া আর কে-ই বা বুজবে? আর তিনিও তো একজন মা। তিনি ওর কষ্টটা খুব ভালোভাবে বুঝলেও এই কষ্টে শান্তনা দেয়ার কোন ভাষা আজ তার কাছে নেই। দরজার পাশে দাড়িয়ে মোমবাতির দিকে তাকিয়ে নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন তিনিও!
প্রথম সন্তান নিয়ে প্রতিটা মায়েরই আনন্দের সীমা থাকে না। মা শব্দটি একটি অক্ষরের, অথচ গভীরতা মহাবিশ্বের থেকেও সহস্রগুন বেশী। আর মাতৃত্বই নারীর পূর্ণতা। তাই স্বভাবতই আনন্দটা বেশীই থাকে।
.
বাঙালী মেয়েদের প্রথম সন্তান বাবার বাড়িতে হবার একটা রেওয়াজ এখনও চালু আছে সমাজে। বর্ণালীরও ব্যাতিক্রম হয়নি। ও যখন সাত মাসের অন্তঃসত্বা তখন থেকেই বাবার বাড়িতে। প্রতিদিন কত নতুন নতুন স্বপ্নের জাল বুনতো মেয়েটি! আগেই জেনেছিলো যে ছেলে হবে, তাই তখন থেকেই ছেলের নামকরন করে দিয়েছে-ঋত।
প্রতিদিন পেটে হাত বুলিয়ে আদর করতো অনাগতকে, কতশত কথা বলে নিজেই হেসে লুটোপুটি হতো! স্বপ্নের ইন্দ্রজালে জীবনটা তখন স্বর্গ মনে হচ্ছিলো।
.
ডাক্তার বলেছে, বেবিকে ভালো রাখতে হলে ইঞ্জেকশন নিতে হবে। যে মেয়ে সূচ দেখেও ভয়ে পালাতো সে-ই ইঞ্জেকশনের মোটা সূই অবলিলায় শরীরে গেথে নিতো, ভয়ের বদলে আনন্দে!
.
তখন নয় মাস। হঠাৎ এক ভোরে দরজার কাছে উঠোনে নামতে গিয়ে পা পিছলে পরে যায় বর্ণালী। খানিকটা উচু জায়গা থেকে পড়ায় সাথে সাথেই একটা চিৎকার দিয়ে সেন্সলেস। সাথে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ।
.
বর্ণালীর বিয়েটা ভেঙে গেছে আজ তিনমাস। এই মা দিবসে ওর-ও তো মা ডাক শোনার কথা ছিলো, অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ঋত-তো চলেই গেল, সেই সাথে ওর মা-ডাক শোনার সম্ভবনাটুকুও নিভিয়ে দিয়ে গেল চিরতরে! সেদিন বহুকষ্টে বর্ণালীকে বাঁচানো গেলেও ওর মা হবার ক্ষমতাটুকু চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছে।
.
তারপর থেকেই বর্ণালী মানসিক ভাবে অসুস্থ। এই "অপয়া" মেয়েকে আর ঘরে তোলেনী ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। আর সৌমিক? সে তো ওকে পালিয়ে বেড়ায় কবে থেকেই!
.
মোমবাতিগুলোও প্রায় শেষ। বেশীরভাগই নিভে গিয়েছে। বাকিগুলোও নিভে যাচ্ছে। ক্রমশ আঁধার ঘনিয়ে আসছে ঘরটিতেও, ঠিক ওর জীবনের মতই! ঘরের চারদিক থেকে একটি বাচ্চার হাসির শব্দ ভেসে আসছে বর্ণালীর কানে। বর্ণালীও অট্টহাসি হাসছে। হঠাৎ করেই সারা ঘরে নিরবতা। কিছুক্ষন পর বালিশটা পায়ের উপর দিয়ে বর্ণালী গাইতে শুরু করলো--
.
সোনা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দিবো কিসে.....
.
বর্ণালীর ঘুমপাড়ানি গানের সুর ক্রমশ দেয়ালের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে। পিছনে দরজায় দাড়িয়ে মুখে কাপড় গুঁজে আছে বর্ণালীর মা। তার দুচোখ উছলেও গড়িয়ে যাচ্ছে বাধভাঙা বানের জল...।
.
বাঙালী মেয়েদের প্রথম সন্তান বাবার বাড়িতে হবার একটা রেওয়াজ এখনও চালু আছে সমাজে। বর্ণালীরও ব্যাতিক্রম হয়নি। ও যখন সাত মাসের অন্তঃসত্বা তখন থেকেই বাবার বাড়িতে। প্রতিদিন কত নতুন নতুন স্বপ্নের জাল বুনতো মেয়েটি! আগেই জেনেছিলো যে ছেলে হবে, তাই তখন থেকেই ছেলের নামকরন করে দিয়েছে-ঋত।
প্রতিদিন পেটে হাত বুলিয়ে আদর করতো অনাগতকে, কতশত কথা বলে নিজেই হেসে লুটোপুটি হতো! স্বপ্নের ইন্দ্রজালে জীবনটা তখন স্বর্গ মনে হচ্ছিলো।
.
ডাক্তার বলেছে, বেবিকে ভালো রাখতে হলে ইঞ্জেকশন নিতে হবে। যে মেয়ে সূচ দেখেও ভয়ে পালাতো সে-ই ইঞ্জেকশনের মোটা সূই অবলিলায় শরীরে গেথে নিতো, ভয়ের বদলে আনন্দে!
.
তখন নয় মাস। হঠাৎ এক ভোরে দরজার কাছে উঠোনে নামতে গিয়ে পা পিছলে পরে যায় বর্ণালী। খানিকটা উচু জায়গা থেকে পড়ায় সাথে সাথেই একটা চিৎকার দিয়ে সেন্সলেস। সাথে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ।
.
বর্ণালীর বিয়েটা ভেঙে গেছে আজ তিনমাস। এই মা দিবসে ওর-ও তো মা ডাক শোনার কথা ছিলো, অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ঋত-তো চলেই গেল, সেই সাথে ওর মা-ডাক শোনার সম্ভবনাটুকুও নিভিয়ে দিয়ে গেল চিরতরে! সেদিন বহুকষ্টে বর্ণালীকে বাঁচানো গেলেও ওর মা হবার ক্ষমতাটুকু চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছে।
.
তারপর থেকেই বর্ণালী মানসিক ভাবে অসুস্থ। এই "অপয়া" মেয়েকে আর ঘরে তোলেনী ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। আর সৌমিক? সে তো ওকে পালিয়ে বেড়ায় কবে থেকেই!
.
মোমবাতিগুলোও প্রায় শেষ। বেশীরভাগই নিভে গিয়েছে। বাকিগুলোও নিভে যাচ্ছে। ক্রমশ আঁধার ঘনিয়ে আসছে ঘরটিতেও, ঠিক ওর জীবনের মতই! ঘরের চারদিক থেকে একটি বাচ্চার হাসির শব্দ ভেসে আসছে বর্ণালীর কানে। বর্ণালীও অট্টহাসি হাসছে। হঠাৎ করেই সারা ঘরে নিরবতা। কিছুক্ষন পর বালিশটা পায়ের উপর দিয়ে বর্ণালী গাইতে শুরু করলো--
.
সোনা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দিবো কিসে.....
.
বর্ণালীর ঘুমপাড়ানি গানের সুর ক্রমশ দেয়ালের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে। পিছনে দরজায় দাড়িয়ে মুখে কাপড় গুঁজে আছে বর্ণালীর মা। তার দুচোখ উছলেও গড়িয়ে যাচ্ছে বাধভাঙা বানের জল...।
Comments
Post a Comment