ইন্ডিয়া ভ্রমন কাহিনী

SaiF UddiN

Image result for india

মি খুবই ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। সময়-সুযোগ হলেই বেরিয়ে পড়ি। আমাদের ছোট্ট এ দেশটার নামকরা ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর প্রায় সবই ঘোরা হয়ে গেছে। চিন্তা করছিলাম দেশের বাইরে যাওয়ার। সবমিলিয়ে ভারত ভ্রমণটাই সবচাইতে ভালো মনে হলো। পাসপোর্টইন্ডিয়ান ভিসাট্রাভেল ট্যাক্সসহ সকল লিগ্যাল ডকুমেন্টস রেডি করলাম !

প্রথম দিন (১৮জুন) – কলকাতা ভ্রমণ

প্রথমবারের মত দেশের বাইরে যাচ্ছি। উত্তেজনায় রাতে ভালো ঘুম হয়নি। বান্দরবান ট্যুরের আগের রাতেও এমন হয়েছিলো। তবুও ভোরবেলা উঠে ফরিদপুর পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে বেনাপোলের গাড়িতে উঠি। বেনাপোল পৌঁছাই বেলা ১১টার দিকে। কাস্টমস ইমিগ্রেশন পেরিয়ে ওপারে (পেট্রাপোল) যেতে যেতে ১২টা বেজে যায়। এপারে ১০টাকা আর ওপারে দাদাদের ১০০টাকা করে ঘুষ দেওয়া ছাড়া আর কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি।
পাসপোর্ট, বহির্গমন কার্ড ও ট্রাভেল ট্যাক্স
শুধুমাত্র একটা বেড়ার এপার আর ওপার তাতেই দৃশ্যপট পাল্টে গেলো। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, মানুষের চালচলন, কথাবার্তা সবকিছুতেই ভিন্নতা। বোঝাই যাচ্ছিলো চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে ভিন্ন কোথাও চলে এসেছি। একটা সিএনজি নিয়ে বনগাঁ স্টেশনে চলে যাই আমরা। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে সেখান থেকে ৭৬কিমি দূরত্বের কলকাতা (দমদম) মেইল ট্রেনের টিকিট কাটি। ট্রেন একদম সময়মত ছাড়লো। মেইল ট্রেন হলে কী হবে কোথাও ক্রসিং বা অন্য কোনকিছুর জন্য ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকেনি। একেকটা স্টেশন আসে ট্রেন ১৫/২০ সেকেন্ডের জন্য থামে আর ঐ সময়ের মধ্যেই লোকজন নামে-উঠে। ট্রেনের দরজা বড় থাকায় নামা উঠা তুলনামূলক সহজ। দমদম পৌঁছাই চারটা পনেরতে। সেখান থেকে মেট্রোরেলে করে যাই এসপ্ল্যানেড।
মেট্রোরেলের সিস্টেমটা খুব ভালো লাগলো। অল্প ভাড়ায় এসিতে বসে দ্রুত শহরের একমাথা থেকে আরেকমাথা চলে যাওয়া যায়। মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি নামছে। তারমধ্যেই হেঁটে বৃষ্টিভেজা কলকাতা শহরের খানিকটা ঘুরে ফেলি। রাস্তাঘাটে প্রচুর গাড়িঘোড়া কিন্তু কোন ভোগান্তি নেই। প্রধান সড়কে কোন রিকশা চলছে না। মানুষজন উল্টোপাল্টা রাস্তা পারও হচ্ছে না। কোন ট্রাফিক পুলিশ নেই কিন্তু সিগনাল মেনে সব গাড়িঘোড়া চলাচল করছে। একটা সিগনালে কোন গাড়ি দুই তিন মিনিটের বেশি আটকেও থাকছে না। নিউমার্কেটের মির্জা গালিব স্ট্রিটে একটি হোটেলে উঠি আমরা। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আশেপাশের এলাকা ঘুরে এসে ৩৫ রুপির হাফ প্লেট কালাভূনা দিয়ে ভূড়িভোজ করে হোটেলে ফিরে আসি।

দ্বিতীয় দিন (১৯ জুন) – কলকাতা ভ্রমন

কালকার (শিমলা) টিকেট পাওয়ার জন্য ট্যাক্সি করে সকাল সকাল চলে আসি ফেয়ারলি প্লেস। আসার পথে ইডেন গার্ডেনের সামনে দিয়ে এসেছিলাম। ভোরবেলা বলে রাস্তায় কোন ভিড় ছিলো না। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার সামনে খালি থাকা সত্ত্বেও রেড সিগন্যাল দেখে গাড়ি থামিয়েছিলো।
ভোরের ফাঁকা কলকাতা ও ইডেন গার্ডেন
ভোরের ফাঁকা কলকাতা ও ইডেন গার্ডেন
আমাদের ভাগ্য ভাল থাকায় ফেয়ারলি প্লেস থেকে ফরেনার কোটায় সেদিনেরই বিকেলের ট্রেনের টিকিট পেয়ে যাই। তারপর কলকাতার রাস্তাঘাট ঘুরে সিম কিনে খাওয়াদাওয়া করে হোটেলে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে গোসল করে বিকেলে বেরিয়ে পড়ি। লোকাল বাসে চড়ে হাওড়া জংশনে চলে আসলাম। হাওড়া জংশন আমার দেখা সবচাইতে বড় স্টেশন। যেদিকে তাকাই শুধু মানুষ আর মানুষ দেখেছিলাম।
আমরা আমাদের ট্রেন খুঁজে নিয়ে উঠে পড়ি। বগিটা ছিলো স্লিপার কোচ। শুরু হলো আমাদের দীর্ঘ ১৭৩৬ কিমি এর ৩২ ঘন্টার ট্রেন জার্নি। গল্প-আড্ডায় রাত নেমে আসে। চাওমিন দিয়ে রাতের খাবার সেরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ি।

তৃতীয় দিন (২০জুন) – ট্রেন জার্নি

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিই। ট্রেন তো সেই অবিরাম চলছে তো চলছেই। ইতিমধ্যে আমরা পশ্চিম বাংলা পার করে ফেলেছি৷ পশ্চিম বাংলার আকাশ আর সবুজ মাঠে আমাদের দেশের সাথে তেমন পার্থক্য না থাকলেও এবার ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা মাটি বলে দিচ্ছিলো এটি ভিনদেশ। সন্ধ্যাবেলা ট্রেন পৌঁছালো ওল্ড দিল্লী স্টেশনে। ছবি-টবি তুলে রাতের খাবার কিনে আমরা আবার ট্রেনে উঠে পড়লাম।

চতুর্থ দিন (২১জুন ) – শিমলা ভ্রমন

হিমাচলের ভোর ও টয় ট্রেন
ভোরবেলা পৌঁছুলাম কালকাতে। আমরা যে হিমাচল প্রদেশে চলে এসেছি কিছুটা শীত শীত করায় তা টের পেলাম। আমাদের গন্তব্য হলো শিমলা। কালকা থেকেও আরো ৯০কিমি এর পাহাড়ি রাস্তা। যেতে হবে টয় ট্রেনে। টয় ট্রেনের জার্নিটা খুব মজার। পাহাড় বেয়ে ট্রেনটা আস্তে আস্তে উপরে উঠতে লাগলো। পথে পড়লো অসংখ্য টানেল।
সাড়ে আটটায় ট্রেন ছাড়লেও পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাজলো তিনটা দশ। হিমাচল প্রদেশের রাজধানী শিমলা পৌঁছানোর পর পুরো অবাক হয়ে গেলাম!
এ আমি কোথায় এসেছি!
পুরো ইউরোপ ইউরোপ লাগছিলো। রাস্তাঘাট একদম পরিষ্কার। আর তাপমাত্রা ছিলো নাতিশীতোষ্ণ (২২ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। দোকানপাট স্থাপনা ইত্যাদি দেখে ইউরোপ মনে হওয়াটা দোষের কিছু না। দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। খাবারের দাম অনেক বেশি ছিলো। সুবিধামত একটা হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে শিমলা শহরটা ঘুরতে বের হলাম। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিলাম। বাতাসটা এতো ফ্রেশ যে খুবই ভাল লাগছিলো। হাটতে হাটতে মল রোড পেরিয়ে শিমলার কেন্দ্রস্থল দ্যা রিজ এ পৌঁছুলাম। সেখানে অনেক পর্যটকের ভিড়। সন্ধ্যা নামলো অনেক দেরী করে আর পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা হিমাচল প্রদেশের শহরগুলো আলোকিত হয়ে উঠলো। রাতে পাঞ্জাবী খাবার খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম।

পঞ্চম দিন (২২জুন) – শিমলা ভ্রমণ

সকালের নাস্তা সেরে আমরা শিমলার সাইটসিয়িংয়ে বের হলাম। কুফরি হলো আমাদের গন্তব্য। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে উঠতে উঠতে পথের ধারে গ্রিন ভ্যালি দেখলাম। কুফরি পৌঁছে ঘোড়া ভাড়া নিয়ে ঘোড়ায় করে গেলাম এপল গার্ডেন, ফাগু ভ্যালি। স্পটগুলো মোটামুটি সুন্দর তবে আহামরি কিছু না। ফেরার পথে পড়লাম বৃষ্টির পাল্লায়। বৃষ্টির ফোঁটা হুলের মতো বিঁধছিলো। আর এক ফোঁটা পানির সাইজের অসংখ্য শিলা পড়ছিলো। এ অবস্থায় পাহাড়ি ঢালু বেয়ে টগবগিয়ে নামা ঘোড়ায় চড়াটা নিঃসন্দেহে ট্যুরের সেরা এডভেঞ্চার ছিলো। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। কিছু কেনাকাটা সেরে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসি। আগেই শিমলা-মানালি বাস টিকেট কেনা ছিলো। রাতের খাবার খেয়ে বাসে চড়ে বসি।

ষষ্ঠ দিন (২৩জুন ) – মানালি ভ্রমন

ভোরবেলা পৌঁছাই মানালি। হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা ছিলো সেখানে। ভোরবেলা বলে মলরোডে লোকের ভিড় ছিলো না। হাটতে হাটতে হোটেল খুঁজতে থাকি। এর মধ্যে চারিদিকে আলো ফুটে উঠে। দূরে পাহাড়ের গায়ে সোনালী রোদের প্রথম কিরণ পড়তেই চূড়ায় জমে থাকা বরফ দেখে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি। হোটেলে এসে রেস্ট নিয়ে আবার বেলা করে বেরোলাম। গতদিন বরফঠাণ্ডা বৃষ্টিতে ভিজে দুজন অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারা হোটেলেই থেকে যায়। মানালি শহর জুড়ে হাটতে হাটতে ঘুরিফিরি ক্লাবহাউস, হাদিম্বা টেম্পল, বনবিহার আর তিব্বতিয়ান মনেস্ট্রি।
ক্লাবহাউস জায়গাটা বেশ সুন্দর। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণা থেকে সৃষ্ট বিয়াস নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে স্থানটি। কয়েক ধরনের এডভেঞ্চার একটিভিটি আছে সেখানে। আমরা তিনজন জিপলাইনিং করে নদীটা ক্রস করলাম। সেইরকম মজা লাগলো।
তারপর গেলাম হাদিম্বা দেবীর মন্দিরে। প্রচুর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেখানে ভীড় করছিলেন। সেখান থেকে আবার মল রোডে ফিরে আসলাম। একটু এগোলেই বন বিহার। জায়গাটি অনেকটা পার্কের মতো। আমাদের দেশের মত বিভিন্ন কোনায় জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়েরা বসে ছিলো। তারপর আমরা গেলাম তিব্বতিয়ান মনেস্ট্রিতে। এখানেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপক আনাগোনা। জায়গাটি বেশ ভালো লাগলো।
সেখান থেকে হোটেলে ফিরে এসে বিশ্রাম নিয়ে আবার রাতের মানালি দেখতে বের হলাম। রাস্তায় এখন বেশ ভিড়। এর মধ্যে একটু ঘোরাঘুরি করে রাতে চিকেন বিরিয়ানী খেয়ে দ্রুত হোটেলে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। পরদিন যে আমাদের ট্যুরের প্রধান আকর্ষণ রোথাং পাস যেতে হবে!

Comments