SaiF UddiN

আমি খুবই ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। সময়-সুযোগ হলেই বেরিয়ে পড়ি। আমাদের ছোট্ট এ দেশটার নামকরা ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর প্রায় সবই ঘোরা হয়ে গেছে। চিন্তা করছিলাম দেশের বাইরে যাওয়ার। সবমিলিয়ে ভারত ভ্রমণটাই সবচাইতে ভালো মনে হলো। পাসপোর্ট, ইন্ডিয়ান ভিসা, ট্রাভেল ট্যাক্সসহ সকল লিগ্যাল ডকুমেন্টস রেডি করলাম !
প্রথম দিন (১৮জুন) – কলকাতা ভ্রমণ
প্রথমবারের মত দেশের বাইরে যাচ্ছি। উত্তেজনায় রাতে ভালো ঘুম হয়নি। বান্দরবান ট্যুরের আগের রাতেও এমন হয়েছিলো। তবুও ভোরবেলা উঠে ফরিদপুর পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে বেনাপোলের গাড়িতে উঠি। বেনাপোল পৌঁছাই বেলা ১১টার দিকে। কাস্টমস ইমিগ্রেশন পেরিয়ে ওপারে (পেট্রাপোল) যেতে যেতে ১২টা বেজে যায়। এপারে ১০টাকা আর ওপারে দাদাদের ১০০টাকা করে ঘুষ দেওয়া ছাড়া আর কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি।

পাসপোর্ট, বহির্গমন কার্ড ও ট্রাভেল ট্যাক্স
শুধুমাত্র একটা বেড়ার এপার আর ওপার তাতেই দৃশ্যপট পাল্টে গেলো। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, মানুষের চালচলন, কথাবার্তা সবকিছুতেই ভিন্নতা। বোঝাই যাচ্ছিলো চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে ভিন্ন কোথাও চলে এসেছি। একটা সিএনজি নিয়ে বনগাঁ স্টেশনে চলে যাই আমরা। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে সেখান থেকে ৭৬কিমি দূরত্বের কলকাতা (দমদম) মেইল ট্রেনের টিকিট কাটি। ট্রেন একদম সময়মত ছাড়লো। মেইল ট্রেন হলে কী হবে কোথাও ক্রসিং বা অন্য কোনকিছুর জন্য ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকেনি। একেকটা স্টেশন আসে ট্রেন ১৫/২০ সেকেন্ডের জন্য থামে আর ঐ সময়ের মধ্যেই লোকজন নামে-উঠে। ট্রেনের দরজা বড় থাকায় নামা উঠা তুলনামূলক সহজ। দমদম পৌঁছাই চারটা পনেরতে। সেখান থেকে মেট্রোরেলে করে যাই এসপ্ল্যানেড।
মেট্রোরেলের সিস্টেমটা খুব ভালো লাগলো। অল্প ভাড়ায় এসিতে বসে দ্রুত শহরের একমাথা থেকে আরেকমাথা চলে যাওয়া যায়। মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি নামছে। তারমধ্যেই হেঁটে বৃষ্টিভেজা কলকাতা শহরের খানিকটা ঘুরে ফেলি। রাস্তাঘাটে প্রচুর গাড়িঘোড়া কিন্তু কোন ভোগান্তি নেই। প্রধান সড়কে কোন রিকশা চলছে না। মানুষজন উল্টোপাল্টা রাস্তা পারও হচ্ছে না। কোন ট্রাফিক পুলিশ নেই কিন্তু সিগনাল মেনে সব গাড়িঘোড়া চলাচল করছে। একটা সিগনালে কোন গাড়ি দুই তিন মিনিটের বেশি আটকেও থাকছে না। নিউমার্কেটের মির্জা গালিব স্ট্রিটে একটি হোটেলে উঠি আমরা। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আশেপাশের এলাকা ঘুরে এসে ৩৫ রুপির হাফ প্লেট কালাভূনা দিয়ে ভূড়িভোজ করে হোটেলে ফিরে আসি।
কলকাতার হাতে টানা রিকশা ৩৫ রুপির কালাভূনা
দ্বিতীয় দিন (১৯ জুন) – কলকাতা ভ্রমন
কালকার (শিমলা) টিকেট পাওয়ার জন্য ট্যাক্সি করে সকাল সকাল চলে আসি ফেয়ারলি প্লেস। আসার পথে ইডেন গার্ডেনের সামনে দিয়ে এসেছিলাম। ভোরবেলা বলে রাস্তায় কোন ভিড় ছিলো না। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার সামনে খালি থাকা সত্ত্বেও রেড সিগন্যাল দেখে গাড়ি থামিয়েছিলো।

আমাদের ভাগ্য ভাল থাকায় ফেয়ারলি প্লেস থেকে ফরেনার কোটায় সেদিনেরই বিকেলের ট্রেনের টিকিট পেয়ে যাই। তারপর কলকাতার রাস্তাঘাট ঘুরে সিম কিনে খাওয়াদাওয়া করে হোটেলে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে গোসল করে বিকেলে বেরিয়ে পড়ি। লোকাল বাসে চড়ে হাওড়া জংশনে চলে আসলাম। হাওড়া জংশন আমার দেখা সবচাইতে বড় স্টেশন। যেদিকে তাকাই শুধু মানুষ আর মানুষ দেখেছিলাম।
আমরা আমাদের ট্রেন খুঁজে নিয়ে উঠে পড়ি। বগিটা ছিলো স্লিপার কোচ। শুরু হলো আমাদের দীর্ঘ ১৭৩৬ কিমি এর ৩২ ঘন্টার ট্রেন জার্নি। গল্প-আড্ডায় রাত নেমে আসে। চাওমিন দিয়ে রাতের খাবার সেরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ি।
তৃতীয় দিন (২০জুন) – ট্রেন জার্নি
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিই। ট্রেন তো সেই অবিরাম চলছে তো চলছেই। ইতিমধ্যে আমরা পশ্চিম বাংলা পার করে ফেলেছি৷ পশ্চিম বাংলার আকাশ আর সবুজ মাঠে আমাদের দেশের সাথে তেমন পার্থক্য না থাকলেও এবার ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা মাটি বলে দিচ্ছিলো এটি ভিনদেশ। সন্ধ্যাবেলা ট্রেন পৌঁছালো ওল্ড দিল্লী স্টেশনে। ছবি-টবি তুলে রাতের খাবার কিনে আমরা আবার ট্রেনে উঠে পড়লাম।
চতুর্থ দিন (২১জুন ) – শিমলা ভ্রমন
ভোরবেলা পৌঁছুলাম কালকাতে। আমরা যে হিমাচল প্রদেশে চলে এসেছি কিছুটা শীত শীত করায় তা টের পেলাম। আমাদের গন্তব্য হলো শিমলা। কালকা থেকেও আরো ৯০কিমি এর পাহাড়ি রাস্তা। যেতে হবে টয় ট্রেনে। টয় ট্রেনের জার্নিটা খুব মজার। পাহাড় বেয়ে ট্রেনটা আস্তে আস্তে উপরে উঠতে লাগলো। পথে পড়লো অসংখ্য টানেল।
সাড়ে আটটায় ট্রেন ছাড়লেও পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাজলো তিনটা দশ। হিমাচল প্রদেশের রাজধানী শিমলা পৌঁছানোর পর পুরো অবাক হয়ে গেলাম!
এ আমি কোথায় এসেছি!
পুরো ইউরোপ ইউরোপ লাগছিলো। রাস্তাঘাট একদম পরিষ্কার। আর তাপমাত্রা ছিলো নাতিশীতোষ্ণ (২২ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। দোকানপাট স্থাপনা ইত্যাদি দেখে ইউরোপ মনে হওয়াটা দোষের কিছু না। দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। খাবারের দাম অনেক বেশি ছিলো। সুবিধামত একটা হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে শিমলা শহরটা ঘুরতে বের হলাম। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিলাম। বাতাসটা এতো ফ্রেশ যে খুবই ভাল লাগছিলো। হাটতে হাটতে মল রোড পেরিয়ে শিমলার কেন্দ্রস্থল দ্যা রিজ এ পৌঁছুলাম। সেখানে অনেক পর্যটকের ভিড়। সন্ধ্যা নামলো অনেক দেরী করে আর পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা হিমাচল প্রদেশের শহরগুলো আলোকিত হয়ে উঠলো। রাতে পাঞ্জাবী খাবার খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম।
পঞ্চম দিন (২২জুন) – শিমলা ভ্রমণ
সকালের নাস্তা সেরে আমরা শিমলার সাইটসিয়িংয়ে বের হলাম। কুফরি হলো আমাদের গন্তব্য। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে উঠতে উঠতে পথের ধারে গ্রিন ভ্যালি দেখলাম। কুফরি পৌঁছে ঘোড়া ভাড়া নিয়ে ঘোড়ায় করে গেলাম এপল গার্ডেন, ফাগু ভ্যালি। স্পটগুলো মোটামুটি সুন্দর তবে আহামরি কিছু না। ফেরার পথে পড়লাম বৃষ্টির পাল্লায়। বৃষ্টির ফোঁটা হুলের মতো বিঁধছিলো। আর এক ফোঁটা পানির সাইজের অসংখ্য শিলা পড়ছিলো। এ অবস্থায় পাহাড়ি ঢালু বেয়ে টগবগিয়ে নামা ঘোড়ায় চড়াটা নিঃসন্দেহে ট্যুরের সেরা এডভেঞ্চার ছিলো। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। কিছু কেনাকাটা সেরে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসি। আগেই শিমলা-মানালি বাস টিকেট কেনা ছিলো। রাতের খাবার খেয়ে বাসে চড়ে বসি।
ষষ্ঠ দিন (২৩জুন ) – মানালি ভ্রমন
ভোরবেলা পৌঁছাই মানালি। হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা ছিলো সেখানে। ভোরবেলা বলে মলরোডে লোকের ভিড় ছিলো না। হাটতে হাটতে হোটেল খুঁজতে থাকি। এর মধ্যে চারিদিকে আলো ফুটে উঠে। দূরে পাহাড়ের গায়ে সোনালী রোদের প্রথম কিরণ পড়তেই চূড়ায় জমে থাকা বরফ দেখে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি। হোটেলে এসে রেস্ট নিয়ে আবার বেলা করে বেরোলাম। গতদিন বরফঠাণ্ডা বৃষ্টিতে ভিজে দুজন অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারা হোটেলেই থেকে যায়। মানালি শহর জুড়ে হাটতে হাটতে ঘুরিফিরি ক্লাবহাউস, হাদিম্বা টেম্পল, বনবিহার আর তিব্বতিয়ান মনেস্ট্রি।
ক্লাবহাউস জায়গাটা বেশ সুন্দর। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণা থেকে সৃষ্ট বিয়াস নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে স্থানটি। কয়েক ধরনের এডভেঞ্চার একটিভিটি আছে সেখানে। আমরা তিনজন জিপলাইনিং করে নদীটা ক্রস করলাম। সেইরকম মজা লাগলো।
তারপর গেলাম হাদিম্বা দেবীর মন্দিরে। প্রচুর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেখানে ভীড় করছিলেন। সেখান থেকে আবার মল রোডে ফিরে আসলাম। একটু এগোলেই বন বিহার। জায়গাটি অনেকটা পার্কের মতো। আমাদের দেশের মত বিভিন্ন কোনায় জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়েরা বসে ছিলো। তারপর আমরা গেলাম তিব্বতিয়ান মনেস্ট্রিতে। এখানেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপক আনাগোনা। জায়গাটি বেশ ভালো লাগলো।
সেখান থেকে হোটেলে ফিরে এসে বিশ্রাম নিয়ে আবার রাতের মানালি দেখতে বের হলাম। রাস্তায় এখন বেশ ভিড়। এর মধ্যে একটু ঘোরাঘুরি করে রাতে চিকেন বিরিয়ানী খেয়ে দ্রুত হোটেলে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। পরদিন যে আমাদের ট্যুরের প্রধান আকর্ষণ রোথাং পাস যেতে হবে!
মানালির হোটেলের থেকে ভিউ বিয়াস নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ক্লাবহাউস বন বিহার এর এক নম্বর গেইট বন বিহারের ভেতরে প্রবেশ করছি তিব্বতিয়ান মনেস্ট্রিতে সপ্তম দিন (২৪জুন) – রোথাং পাস ভ্রমণ
সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমরা। গতদিন গাড়ি রিজার্ভ করে রাখা হয়েছিলো। সেটাতে চড়ে বসলাম। খানিক বাদেই গাড়িটি আবার পাহাড় চড়তে লাগলো। যত সময় গেল শুধু উপরে উঠতেই থাকলাম। পথে এক জায়গা থেকে বরফে চলার জন্য কাপড় ভাড়া করে নিলাম। একসময় পৌঁছুলাম সোলাং ভ্যালিতে। জুন-জুলাই মাস ছাড়া বছরের অনান্য সময় এতো বরফ পড়ে যে রোথাং পাসের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন সোলাং ভ্যালিতেই বরফ পাওয়া যায়। সেখানে তেমন কিছু দেখলাম না।সোলাং ভ্যালি (রোথাং পাস যাওয়ার পথে) ছুটে চলেছি রোথাং পাসের পথে… পথে বিরতি দেওয়া হলো এমন অনিন্দ্যসুন্দর একটা জায়গায় আবার গাড়িতে চড়ে চলতে শুরু করলাম। মাত্র দেড় মাস খোলা থাকে বলে রোথাং পাসের রাস্তায় প্রচণ্ড ভীড়। পুরো ভারত থেকেই প্রচুর মানুষ এসেছে। সাদা চামড়ার দুয়েকজন বিদেশীও দেখলাম। এরকম পাহাড়ি রাস্তাতেও দেখলাম প্রচুর মানুষ বাইকে করে যাচ্ছে। এমনকি দুই-তিনজন সাইক্লিস্টসও দেখলাম। রাস্তায় জ্যামে বসে থাকতে হলো অনেকক্ষণ। হাজার হাজার গাড়ির সিরিয়াল রোথাং পাসের রাস্তায়।প্রচণ্ড জ্যাম। ভারতের সব লোক বোধহয় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রোথাং পাসের রাস্তায় গতদিন দূর পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা যে বরফ দেখেছিলাম আজ তার কাছাকাছি চলে এসেছি। ধীরে ধীরে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যাচ্ছি। এখন বেশ কাছ থেকেই বরফ দেখতে পাচ্ছি। দূরে অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে মানালি শহর!অবশেষে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ফিট উচ্চতায় রোথাং পাসে পৌঁছুলাম। চারিদিকে বরফ আর বরফ। হাত দিয়ে একদলা বরফ ছুঁয়ে দেখলাম। বেশ ভাল লাগছিলো। অনেক মানুষ এসেছে এখানে। আমরা বরফে স্লাইডিং করলাম। স্নো বল বানিয়ে একে অপরকে ছুড়ে মারলাম।অবশেষে- রোথাং পাস! এর মধ্যে ঠিক মাথার উপরেই মেঘ ঘনিয়ে আসলো। শুরু হলো বৃষ্টি। ঠাণ্ডায় কাঁপন ধরে গিয়েছিলো। পরে গাড়িতে চলে আসলাম। বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি ছেড়ে দিলো। পুরোটা জায়গা মেঘে আচ্ছাদন করে রাখায় আশেপাশে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিলো না। গাড়িগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে খুব সতর্কতার সাথে চলছিলো।ফিরতি পথে মেঘ ঘিরে ধরলো আমাদের। ডানে বরফ বায়ে পাহাড়ি খাদ আর সামনে মেঘে ঢেকে ফেলা রাস্তা রোথাং পাস আসার পথে আমরা পাহাড়ের এক রূপ দেখেছিলাম। এখন আবার ফেরার পথে আরেক রূপ দেখতে পেলাম। মাঝে গাড়ি ব্রেক দিলো। নেমে চা নাস্তা করলাম। আর চোখের সামনে অভূতপূর্ব একটা দৃশ্য দেখলাম। চোখের সামনে মেঘ জমতে দেখলাম। যে দৃশ্যটা খুবই সুন্দর ছিলো।রাস্তায় ঝুলে থাকা একখণ্ড মেঘ যখন মেঘেরা গ্রাস করে ফেলে আস্ত এক পাহাড়! এভাবে চলতে চলতে মানালি পৌঁছলাম। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। রুমে খাবার নিয়ে এসে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম।অষ্টম দিন (২৫ জুন) – দিল্লী যাত্রা
আমি ঘুম থেকে উঠলাম প্রায় এগারোটায়। বাইরে বৃষ্টির মধ্যেই সকালটুকু যে যার মতো ঘুরলো। আমি কম্বল পেঁচিয়ে আরাম করে শুয়ে শুয়ে ভারতের চ্যানেলগুলো দেখতে লাগলাম। গোসল করে রেডি হয়ে নিলাম। দুপুরবেলা বের হয়ে খাওদাওয়া করে মল রোডের পাশেই বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে উঠলাম। তিনটা বিশে দিল্লীর উদ্দেশ্যে বাস ছাড়লো। একটু ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়ায় ঔষধ খেয়েছিলাম যার ফলে বাসের সিটে হেলান দিয়ে মরার মত ঘুমালাম। মাঝে একটু সময় হুশ ফিরে আসলে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম মানালি থেকে কুল্লু-মান্ডির রাস্তায় আমরা। বিয়াস নদীর তীর ঘেঁষে দুই পাহাড়ের মাঝের গিরিখাতে বাস ছুটে চলেছে। যত নামতে লাগলাম ততই নদীর প্রশস্ততা আর স্রোত বাড়তে থাকলো। মাঝখানে একটা পাহাড়ের ভেতর টানেল পার হলাম। আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলো রাতের বেলা বাস একটা রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য ব্রেক দেওয়ায়। আবহাওয়া ঠাণ্ডা থেকে আবার অনেকটাই গরম হয়ে গিয়েছে। খাবারের দাম না জানি কেমন হয় এই ভয়ে ভয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখি মাত্র ৭০রুপিতে ব্যুফে দিচ্ছে যাতে আছে আনলিমিটেড রুটি, সবজি, ভাত ইত্যাদি!নবম দিন (২৬ জুন ) – দিল্লী ভ্রমন
ভোরবেলা পৌঁছুলাম দিল্লীতে। আগে গেলাম নয়াদিল্লী রেল স্টেশনে কলকাতার টিকিট কাটতে। আগ্রা-কলকাতা টিকিট কেটে চলে আসলাম জামে মসজিদ এলাকায়। হোটেল খুঁজে একটা রুম নিয়ে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে নিলাম। দুপুরে জামে মসজিদে নামাজ পড়লাম। জামে মসজিদ স্থাপনাটি প্রাচীন ও সুন্দর।দিল্লীর জামে মসজিদের তোরণ! ভোরবেলার জামে মসজিদ সেখান থেকে হেঁটে গেলাম রেড ফোর্ট তথা লাল কেল্লায়। দিল্লীতে তখন ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। স্বর্গের মতো বরফ এলাকা ছেড়ে যেন দোযখে এসে পড়েছি। রোদে ঝলসে কাবাব হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এর মধ্যেই লাল কেল্লায় ঢুকলাম। বিশাল এক দুর্গ এই লাল কেল্লা। ভিতরেও অনেক বড় বড় স্থাপনা আছে।লাল কেল্লা। যার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ক্যামেরায় ধরে না। সেখান থেকে বেরিয়ে উবারে করে গেলাম ইন্ডিয়া গেট। ভারতের স্মৃতিসৌধ বলা চলে এটাকে। সন্ধ্যা নামতে ইন্ডিয়া গেটের লাইটিং একে আরো মনোমুগ্ধকর করে ফেলল।ইন্ডিয়া গেট রাতের ইন্ডিয়া গেট দিল্লীর রাস্তাঘাট ঘুরে আমরা আবার জামে মসজিদ এলাকায় ফিরে আসলাম। এখানে কেজি দরে বিরিয়ানি বিক্রি করে। ৭০রুপিতে হাফ কেজি খাসির বিরিয়ানী দিয়ে খাওয়া সেরে রুমে চলে আসলাম।দশম দিন (২৭ জুন ) – তাজমহল ভ্রমন
ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে স্টেশনে চলে আসলাম। গন্তব্য ২০০কিমি দূরের আগ্রা।প্রায় তিন ঘন্টা পরে আগ্রা পৌঁছুলাম। স্টেশন থেকে সোজা চলে গেলাম তাজমহলে। আগ্রাতে গরম আরো বেশি। তাপমাত্রা ৪৩ডিগ্রি ছিলো তখন। চোখের সামনে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য তাজমহল দেখে বেশ ভাল লাগছিলো।সপ্তাশ্চর্য!
তাজমহলছবিটবি তুলে ঘোরা ফেরা করে চলে আসলাম আগ্রা ফোর্টে। অনেকটা লাল কেল্লার মতোই এই আগ্রা ফোর্ট। আগেকালে রাজারা এমন সব দুর্গে থাকতো ভাবতেই মন আনমনা হয়ে যায়। স্থাপনাগুলোও বিশাল বিশাল। আর দুর্গের বাইরে শত্রুর মোকাবিলার জন্য বড় পাঁচিল করা আর তার সামনে পরিখা।আগ্রা ফোর্টের প্রবেশপথ আগ্রা ফোর্টের ভেতরের একটি স্থাপনা ঘোরা শেষ হলে আবার স্টেশনে চলে আসলাম। খাওয়াদাওয়া সেরে স্টেশনে রেস্ট নিলাম কিছুক্ষণ। ট্রেন আসলে চড়ে বসলাম ট্রেনে। প্রায় ২৪ ঘন্টার জার্নি আগ্রা টু কলকাতা। এটাও ছিলো স্লিপার কোচ। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।একাদশতম দিন (২৮জুন ) – ট্রেন জার্নি
সারাদিন ঝিকঝিক করে ট্রেন চললো। প্রচন্ড গরমে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছিলো। ট্রেন থেকে বাইরে তাকালেও তেমন একটা সবুজের দেখা মিলছিলো না। অনেকটা মরুভূমির টাইপের। একে তো গরম আবার এত লং ট্যুর হওয়ায় সবাই কেমন জানি ঝিমিয়ে পড়ছিলো। ট্রেনের জানালার ধারে বসে বসে কেমন দেশের কথা ভেবে একটু বিষণ্ণ লাগছিল। অবাক লাগছিলো একদম সবজায়গায় চার লেনের রাস্তা করে রেখেছে সরকার কিন্তু মাঝেসাঝে দুয়েকটা বড় ট্রাক ছাড়া কোন গাড়ি চোখে পড়ছিলো না। আর রেললাইনের জন্য কোন রাস্তায় ক্রসিং নাই। সবখানে ওভারপাস অথবা নিচ দিয়ে টানেল তৈরি করে দেওয়া; একদম অজপাড়াগাঁয়েও।বিকেলবেলা গরমটাও কমে এল আর আমরা পশ্চিম বাংলায় প্রবেশ করলাম। রাতে কলকাতার দমদমে নেমে মেট্রোতে করে চলে আসলাম আবার সেই নিউমার্কেটে। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছিলো। আবার সেই কালাভূনা দিয়ে তৃপ্তি করে খেয়ে হোটেলে আসলাম। ব্যাগ ব্যাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে দশটার দিকে বের হলাম। ঘুরলাম রাতের কলকাতা। ডোমিনোজ পিজ্জা চোখে পড়ায় টেস্ট করলাম। তারপর হোটেলে চলে আসলাম আবার।দ্বাদশ দিন/শেষ দিন (২৯জুন) – দেশে ফেরা
আজ দেশে ফেরার পালা। দীর্ঘ বারো দিনের পর দেশে ফিরছি ভাবতেই ভালো লাগছিলো। আবার ট্যুর শেষ ভেবে খারাপও লাগছিলো। সকালবেলাটা আমরা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি আর কেনাকাটা করেই কাটিয়ে দিলাম। ট্যাক্সিতে করে শিয়ালদহ এসে বনগাঁর মেইল ট্রেনের টিকিট কেটে চড়ে বসলাম। দুই ঘন্টার কিছু কম সময় লাগলো আসতে। বৃষ্টি পড়ায় গরম থেকে স্বস্তি মিলছিলো। বনগাঁ থেকে পেট্রাপোল বর্ডারে এসে অল্প যা রুপি ছিলো সব খরচ করে ফেললাম। তারপর বর্ডার ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম খুব সহজে মাত্র পনের মিনিটের মধ্যেই। বেনাপোল ঢুকে আগে বাংলার ভাত আলুভর্তা ডিমভাজি আর ডাল দিয়ে দেশি স্বাদে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এই খাবারই অমৃত মনে হচ্ছিলো। তারপর বাসে চড়ে ফরিদপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা বাজলো। আর শেষ হলো বারো দিনের ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া ট্যুরের!খরচের হিসাব – ১০৩২৫ রুপিতে ১২ দিনের ভ্রমণ!
বি. দ্র. দেশে হোক দেশের বাইরে হোক নির্দিষ্ট স্থান ব্যতীত কেউ কোন আবর্জনা ফেলবেন না। পরিবেশ ঠিক রাখুন আর ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করুন!
Comments
Post a Comment