কুয়াকাটা ভ্রমণের আদ্যপান্ত (খরচ ও গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা)

SaiF UddiN

Image result for কুয়াকাটা ভ্রমণের

কুয়াকাটা ভ্রমণ:
আমরা গিয়েছিলাম ৭ জন। সবাই আগের দিন রাত পর্যন্ত অনিশ্চিয়তার মধ্যে থাকার পরও পরদিন সদরঘাট চলে গেলাম। খাবারের পর্বটা সেরে সন্ধ্যা ৬.৩০ টার ঢাকা-বগা-পটুয়াখালী লঞ্চে উঠে গেলাম, লঞ্চে উঠার আগে রাতের জন্যে কিছু নাস্তা কিনে নিলাম কারণ লঞ্চে জিনিসের দাম অনেক বেশি। শুধুমাত্র এরকম লঞ্চ জার্নি উপভোগ করার জন্যে হলেও ১৫০০-২০০০ টাকা খরচ করা ব্যাপার না। যদিও দিনের বেলা হলে আরো বেশি উপভোগ্য হতো ।

ভোর ৪.০০ টায় পটুয়াখালী সদরঘাট নেমে অটোতে করে বাস স্ট্যান্ড গেলাম সেখান থেকে বাসে করে কুয়াকাটা। প্রথমে নেমে মনে হয়েছিল তেমন বেশি ভাল লাগবে না, বন্ধুদের কেউ কেউ বলছিল পতেঙ্গা(চট্টগ্রাম) বীচের মত। কয়েকটা হোটেল দেখে ওয়েস্টার্ন হোটেলে চার বেডের(৭-৮ জন থাকা যাবে) একটা রুম নিলাম। আমি চেয়েছিলাম হোটেলটা যেন বীচ থেকে খুব কাছে হয় সে হিসেবে দাম টাম(১৭০০ টাকা, ১২.০০-১২.০০টা) সব মিলিয়ে ভালোই লেগেছে। একটা রুম নিয়ে দুপুরের ভাত খেলাম রাজধানী হোটেলে(দাম ও মান খারাপ না)।

বিকালে বীচে যাওয়ার আগে চৌরাস্তার পাশে একটা বৌদ্ধ মন্দির আছে সেটা দেখে নিলাম যেটার পাশেই ‘কুয়া’ টি যার নামে কুয়াকাটা নামকরণ করা হয়েছে।
যখন বীচে গেলাম সবাই মিলে তখন সাগরের উত্তাল ঢেউ ও গর্জনে পার্থিব সবকিছু ভুলে অসাধারণ অনুভূতি কাজ করলো। কক্সবাজারের মত এখানে ফুটবল খেলা নিয়ে কোন রেস্ট্রিকশন নেই। বেশি ভাল লেগেছে কক্সবাজারের মত কুয়াকাটায় মানুষ গিজগিজ করে না আর যে বিষয়টি উল্লেখ্য, কক্সবাজারের সমুদ্রের পানি অনেক নোনতা যার ফলে কিছুক্ষণ পানিতে লাফালাফি করলেই চোখ নাক জলে যেটা কুয়াকাটার পানিতে অনেক কম। আমরা প্রায় ৩.৫ ঘন্টা ছিলাম পানিতে কিন্তু চোখ জলে নি যেটা কক্সবাজারে ভাবাই যায় না।

কুয়াকাটা লাল কাঁকড়া


১ম দিন সন্ধ্যা আর রাত টা বীচে-মার্কেট এ কাটিয়ে দিলাম। পরদিন সকালে কিছুক্ষণ বীচে থেকে ডাব খেয়ে হোন্ডা ভাড়া করে নিলাম বীচ থেকে দূরে অন্যান্য দ্বীপ টিপ ঘুরার জন্যে। ওরা ১৭-১৮ টা প্লেস ঘুরানোর কথা বলে আসলে প্লেস মাত্র ৫-৬ টা। প্রথম নিয়ে গেল রাখাইন পল্লীতে যার মুখেই আরেকটি বৌদ্ধ মন্দির আছে যেখানে ৩৬ ফুট লম্বা একটি মূর্তি আছে। রাখাইন পল্লীটা অনেক ব্যাতিক্রম ও চমৎকার লেগেছে। ওদের ঘর বাড়ি, জীবনযাপন সত্যি অসাধারণ মনে হয় যেন অন্য কোন দেশ। বাড়ির আঙিনা ছোট ছোট গাছে ভর। টিনের দোতলা ঘর, ঘরের সামনে ওদের বানানো জামা কাপড়ের দোকান ইত্যাদি এক কথায় অবিশ্বাস্য।

সেখান থেকে গেলাম ঝাউবন সংলগ্ন কুয়াকাটার শেষমাথায় যেখানে পানির রঙের কথা বাদ দিলে সেন্টমার্টিনের ফিলিংস আসে। বীচের পাড় পুরোটা ঝাউ গাছে ভরা, বিশাল ঝাউ বাগান আরেক পাশে কিছুটা নিস্তব্ধ সাগর। কপালে থাকলে সেখানকার লাল কাঁকড়া গুলো চোখে পড়বে যেগুলো সূর্যের কিরণ বাড়ার সাথেসাথে গর্ত থেকে ঝাঁকেঝাঁকে বেরিয়ে আসে। খুব সুন্দর দেখতে।
ঝাউবন থেকে বীচের উপর দিয়ে সোজা চলে যাবে গঙ্গামতী চরের দিকে ঝাউবন বীচ থেকে একটু এগিয়ে গেলেই বিভিন্ন ধরনের গাছপালা ও এক পাশের সমুদ্রের পানি আর সাথে বাইক রাইডিং আপনাকে মুগ্ধ করবেই আর মনে হবে “এই পথ যদি না শেষ হয়” বাইকওয়ালা মামাদেরকে বললে ছবি তোলার জন্যে বা এমনিতে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে।

কুয়াকাটা গঙ্গামতীর চর


সেখান থেকে ছোট একটা নদী পার হয়ে(পার বাইক ৩০/- টাকা) গঙ্গামতীর চর সেখানেও একপাশে সাগর, আরেক পাশে বিচিত্র রকমের গাছ বাইকে পেরিয়ে একটা রাস্তা ধরে পাড়ে উঠে আসবে সেখান থেকে সোজা কুয়াকাটা মেইন বীচের চৌরাস্তা পেরিয়ে অন্য দিক চলে যাবে যেখানে #লেবুর_চর ও #তিন_নদীর মোহনা দেখিয়ে নিয়ে আসবে। তিন নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে #ফাতরার_চর দেখা যায় যেটি সুন্দর বনের একটি অংশ। শীতকালে কুয়াকাটা বীচ থেকে বোটে করে সেখানে যাওয়া যায় কিন্তু আমাদের ভাগ্যে সেটি দূর থেকে দেখার সৌভাগ্যই মিলল। তবে আপনি বেশি সময় নিয়ে কুয়াকাটা গেলে চৌরাস্তা থেকে ভ্যান গাড়ি করে #আলীপুর বীজ পর্যন্ত যেতে পারেন সেখান থেকে ট্রলারে ৪০-৫০ টাকা করে ফাতরার চর যাওয়া যায়। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় সূর্যোদয় সূর্যাস্ত ভালোভাবে দেখার সুযোগ হয় নি।
সত্যি বলছি বাইক রাইডিং টা পয়সা উসুল রাইড ছিল।

২য় দিন রাতে প্রায় ৪ কেজি ওজনের টুনা মাছের BBQ খেয়েছিলাম। অসাধারণ ছিল। ট্যুরের পূর্ণতার উপকরণ ছিল সেটি।
সবাই জায়গাটার মায়ায় পড়ে গেলাম। সবার মন খারাপ ছিল সাগর কন্যা কুয়াকাটা ছেড়ে আসতে। মনে হচ্ছিল আরো এক রাত থেকে যাই।
অনেকেই বলে পটুয়াখালী হয়ে গেলে নাকি ভাল কিন্তু আমরা আসার সময় বরিশাল সদরঘাট হয়ে এসেছি যেটা বেস্ট মনে হয়েছে আমার কাছে। রাস্তাগুলো অসাধারণ। বরিশাল দিয়ে আসায় যে লাভটা হলো সেটা হলো, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দেখা, ঝালকাঠি জেলাটা দেখা, বরিশালের মত সিম্পল, সুশৃঙ্খল, গোছালো, Noise-disturbanceless, জ্যাম-ঝামেলাহীন অথচ অনাড়ম্বর শহরটা দেখা। অসাধারণ ছিল শহরটা। হাতে সময় থাকলে অনেকক্ষণ সেখানে আড্ডা দেয়া যেতো।

কুয়াকাটা টুনা মাছ। প্রায় ৪ কেজি। বারবিকিউ করা সহ ৮০০ টাকা।

জেনে রাখবেন:
১. টাইমিং অনেক ইম্পর্টেন্ট। ঢাকা থেকে পটুয়াখালীর লঞ্চ সন্ধ্যা ৬-৭ টায় ছাড়ে, একই সময়ে পটুয়াখালী থেকেও ছাড়ে। আর ঢাকা থেকে বরিশালের লঞ্চ ৭.৩০-৮.৩০ টায় ছাড়ে, একই সময়ে বরিশাল থেকেও ছাড়ে। আর বাস রাত ৯.০০ টা পর্যন্ত (কলাপাড়া থেকে ঢাকা)
২. বরিশাল যাওয়ার জন্য বাস জার্নি করা বোকামি।
৩. লঞ্চ এ ডেকের(ডেক মানে আপনার কোন নির্দিষ্ট সিট নেই আপনি এর বাইরে লঞ্চের যে জায়গায় নিজের জায়গা করে নিতে পারেন কেবিনের বাইরে) টিকেট কাটলে লঞ্চে উঠা মাত্রই দোতলায় যে পাশে কেবিন আছে সে পাশে মানে একদম সামনের দিকটা দখল করে নিবেন।
৩. পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা অথবা বরিশাল/লেবুখালী থেকে কুয়াকাটার পথটা weather ভাল থাকলে বাসের ছাদে করে যাবেন অবশ্যই এতে ভাড়াও সেভ হবে আর নদীমাতৃক এলাকাটির অপরূপ সৌন্দর্য ও দেখতে পাবেন।
৪. বাইক, হোটেল ও অন্যান্য দরাদরির বিষয়গুলোতে তুমুল দরদাম করবেন। বাইকে দুজন করে নেয়। আমরা ৬০০/- করে নিয়েছিলাম। বাইক আপনি চাইলে নিজেও ড্রাইভ করতে পারেন তবে সেটা না করাই ভাল কারণ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা আছে।
৫.১ম দিন রাতে পরের দিনের জন্যে বাইক ভাড়া করে রাখুন, পরদিন ভোরে ওরাই আপনার হোটেলের সামনে গিয়ে আপনাকে কল দিবে।
৬.DSLR, বাইকওয়ালা এদের বারংবার প্রশ্ন ও যন্ত্রণা এড়াতে কৌশলি হবেন।
৭. দাম টাম সব মিলিয়ে পুষিয়ে আসার মত ভাল হোটেল কম। দু একটা 5 star মানের হোটেল আছে আর কিছু 3 star মানের হোটেল আছে বাকিগুলো সাধারণ।
৮. চা-টা ও হালকা নাস্তার জন্যে চৌরাস্তা থেকে বেড়িবাঁধ রোডে একটু বামে গেলে ছিদ্দিক চাচার দোকান আছে। চাচা অনেক ভাল মানুষ, চা ও খারাপ বানায় না। ওখানকার কোন তথ্য জানার হলে নির্ভয়ে চাচাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
চাচার নাম্বার: 01829879722
৯. পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা বাসগুলো সিটিং না তবে কিছুক্ষণ পরপর ই একটা বাস ছাড়ে এছাড়াও একদম লঞ্চঘাটের সামনে থেকে বাইকে করে পটুয়াখালী যাওয়া যায়(জনপ্রতি ভাড়া ৩৫০-৬০০টাকা, সিজন অনুযায়ী)।
১০. আপনি যাওয়ার আগে অবশ্যই কুয়াকাটার weather দেখে যাবেন কারণ এখন বৃষ্টির মৌসুম।
খরচ
১. ঢাকা টু পটুয়াখালী লঞ্চ ডেকে ২৫০-৩০০ টাকা, ঢাকা টু বরিশাল লঞ্চ ২৫০ টাকা। বরিশালের লঞ্চগুলো তুলনামূলক ভাল। ডাবল কেবিন ১৮০০-৩৫০০(মান ভেদে) টাকা
২.পটুয়াখালী টু কুয়াকাটা বাসের সিটে ১৫০ টাকা (নরমালী ৮০ টাকা কিন্তু পর্যটকদের থেকে ১৫০ করে নেয়) ছাদে গেলে ৭০-৮০ টাকা। পটুয়াখালী টু লেবুখালী/বরিশাল ২০০-২৫০।
৩. লেবুখালী থেকে বরিশাল সদরঘাট Mahindra করে জনপ্রতি ১৫০ টাকা।
৪. লঞ্চের ডেকে যাওয়াই ভাল। বিশেষ করে যদি ফ্রেন্ড সার্কেল হয়।
কিছু নাম্বার:
১.ওয়েস্টার্ন হোটেল। ফ্যামিলি রুম ১৫০০-২০০০। থাকতে পারবেন ৪-৮ জন। নাম্বার: 01743037869(মিজান ভাই-ম্যানেজার)
২.হোটেল সাগরকন্যা। নন এসি টুইন। ভাড়া ১৭-১৮০০। থাকতে পারবেন সর্বোচ্চ ৪ জন। 01748424729
৩.হোটেল বিশ্বাস সী প্যালেস। ভাড়া ২০০০ নন এসি টুইন।
01730093356
৪.হোটেল কুয়াকাটা ইন। ভাড়া ১৪০০-১৬০০ নন এসি টুইন। 01750008177
(3 star মানের হোটেলগুলোতে টুইন রুমে ৪ জনের বেশি allowed না)
৫. পটুয়াখালীর লঞ্চ:
কুয়াকাটা-১। ০১৭৩৬৬২০৫৮০
সুন্দরবন-৯। ০১৭১১৩৫৮৮১০
৬. বরিশালের লঞ্চ:
সুন্দরবন-৯। ০১৭১৪০১৭২৭২
সুরভী-৮। ০১৭১২৭৭২৭৮৬
অনুরোধ :
আমাদের একটাই উপসাগর/ সাগর তাই কেউ একটি চিরকুটও ফেলবেন না দয়া করে। যাওয়ার সময় লঞ্চে কিছুক্ষণ পরপর ই কেউ না কেউ কিছু না কিছু ফেলছে। দয়া করে সাগর বা নদীতে কিছু ফেলবেন না। অনেক স্মার্ট, শিক্ষিত ভদ্রলোক ও এই কাজটি করে। এক সময় সব নদীই বুড়িগঙ্গার মত হয়ে যাবে। ভাবুন একবার। পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে কি রেখে যাচ্ছি আমরা। কি ফেলছেনা মানুষ নদী-সাগরে। ডাব, ড্রিংস খেয়ে বোতলটা বীচে ফেলে আসছে। একটু কষ্ট করে পাড়ে এনে ফেললে কি হয়।

Comments