"লিফটে এক সাথে ব্যাচেলর ছেলে মেয়ে ওঠা নিষেধ।"
প্রতিদিন বিকাল পাঁচটার দিকে লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজে লেখা কথাটার দিকে মনোযোগ সহকারে দেখে মিনার। আর বিস্ময়ের সাথে ভাবে লিফটের ভিতর কী এমন করতে পারে দুইটা ব্যাচেলর ছেলে মেয়ে যে এমন কিছু সাটিয়ে রাখতে হবে। এ বাড়ির ছয় তলার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কিছু ছেলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। স্পষ্টতই বোঝা যায় এই কাগজে লেখা কথার ইঙ্গিত তাদের দিকেই। মিনার এ বাড়িতে থাকে না। এ বাড়ির চার তলায় টিউশনি করায়। তুহিন আর তুলি দুই ভাই বোনকে পড়ায়। তুহিন নবম শ্রেণি আর তুলি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। গত কয়েকদিন ধরে পাঁচটার সময় পড়াতে যাওয়াটা কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। পাঁচটা থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচটা, কোনদিন পৌনে ছয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে মিনার। মেয়েটা আসে এর মাঝেই। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে পকেটের মোবাইলের ঘড়িতে সময় দেখে আর নিজের অনেক বার করে সেলাই করা জুতাটার দিকে তাকিয়ে কিছু হিসাব করে। সেই হিসাব খুব জটিল কিছু বা খুব সহজ। আধুনিক বেশ ভূষার এই মেয়েটার নাম জানে না মিনার। হয়ত ভার্সিটি শেষ করে বাসায় ফিরে মেয়েটা। মিনারের লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার মাঝে মেয়েটা চলে আসলে, লিফটের সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। মেয়েটাকে লিফটে ওঠার সুযোগ দেয়। ব্যাচেলর ছেলে মেয়ে একসাথে লিফটে ওঠা নিষেধ। একসাথে লিফটে ওঠা হয় না। তাই মেয়েটা লিফটে ওঠার আগ পর্যন্তই অপলক তাকিয়ে দেখা। মেয়েটাও কখনও তাকায়। কখনও চোখ ফিরিয়ে নেয়। কখনও মুখের উপর পড়া চুলের গুচ্ছ হাত দিয়ে সরিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে যায়। সাদা মাটা পোশাকের মেয়েদের চেহারার মাঝে কেমন যেন একটা স্নিগ্ধ ভাব থাকে। বেশি আধুনিক বেশভূষায় তা হারিয়ে যায়। কিন্তু এই মেয়ের ব্যাপারটা আলাদা। এমন পোশাকেও স্নিগ্ধ ভাবটা চলে যায় নি। একবার তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেয়া অসম্ভব। কিছু একটা আছে, যা বার বার তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে।
মেয়েটা আসার পর আজও জায়গা ছেড়ে দিল মিনার। মেয়েটা লিফটে চড়ে মিনারকে উদ্দেশ্য করে বলে, উপরে যাবেন?
- জ্বি।
- আসুন। আপনি অপেক্ষা করছিলেন তো আগে থেকেই।
- না না ঠিক আছে। যান আপনি।
- আরে সমস্যা নেই আসুন।
মিনার কাগজে লেখা কথাটার দিকে আর একবার তাকায়। মেয়েটা আলতো হাসি দিয়ে বলে, আরে কিছু হবে না। চলেন।
মিনার হালকা কাঁপন নিয়ে বুকে ধীরে ধীরে লিফটে উঠে।
- কয় তলায় যাবেন?
- চার তলায়। তুহিন আর তুলির টিচার আমি।
- আচ্ছা আচ্ছা। আমরা পাঁচ তলায় থাকি। কোথায় পড়াশুনা করেন?
- জ্বি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফিজিক্সে।
- বাহ, ভাল ছাত্র। আমি UIB তে, সি এস ই।
মিনার অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে, মেয়েটা নিজে থেকেই কথা বলে যাচ্ছে। আর মিনারের কথা বলার সময়টায় কেমন একটা ভয় ভয় কাজ করছে। ভয়টা কোথায় জানে না। কেমন যেন অস্বস্তি, কেমন যেন দ্বিধা, কেমন একটা আবছা বিষণ্ণতা। মিনারের কথা বলার চেয়ে মনোযোগের মাত্রাটা বেশী, নিজের জুতা গুলো আড়াল করায়। দেড়শ টাকার জুতার পিছনে সেলাই করতে খরচ করেছে এখন অবধি মনে হয় একশ টাকার উপরে। পাঁচ বারে বিশ টাকা গায়ে লাগে না। যতটা না একবারে একশ টাকা অনেক টাকা মনে হয়।
- চার তলায় চলে এসেছেন।
নেমে যাবার আগে শেষ কথা ছিল মেয়েটার, নামটা জানা হল না।
- মিনার।
- আমি ঈপ্সিতা। দেখা হবে কেমন?
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ঈপ্সিতা সেদিন চলে গিয়েছিল। পড়াতে গিয়েও মিনারের ঘোরটা কেমন কাটছিল না। ঈপ্সিতার বলা কথা মত আবার দেখা হয়েছিল। যেদিন পড়াতে আসত মিনার সেদিনই দেখা হত। লিফটের উপরে সাটানো কথাটা অবাধ্য করে দুজন লিফটে চড়ত। প্রতি দিনকার সেই মিনিট খানেক কথা বলার ভাল লাগার রেষটা সারাদিন দাপিয়ে বেরাতো মিনারের মনে। তবু গভীরভাবে ভাবনার সময়টায় মিনারের মনটা বিচ্ছিন্ন লাগত। লিফটে উঠে জুতা আড়াল করতে ভাল লাগত না। দেড়শ টাকা বেশী টাকা না। তবুও হিসেব করে চলার দিন গুলোতে হুট করে জুতা কেনাটা সম্ভব মনে হত না মিনারের। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এই লিফট পরিচয়ের বন্ধুত্ব কিছুটা গাঢ়ত্ব পায়। ঈপ্সিতা একেক দিন একেকটা ব্যাপার নিয়ে আলাপ শুরু করে। কিন্তু মিনিট খানেকে তা শেষ হয় না। তাই অসমাপ্ত রেখেই চলে যেতে হয়। "আবার দেখা হবে" বলে বিদায় নিতে হয়। সব অসমাপ্ত গল্প গুলোর একটা সমাপ্তি ভেবে নিত মিনার। ঈপ্সিতার বলা অংশের শেষটা ঠিক মনের মাঝে এঁকে নিত, লিখে নিত। কখনও সে গল্পের সাথে নিজের কোন যোগসূত্র খুঁজত। কল্পনার কল্পনায় কোন ভাবে সে গল্পের দৃশ্যপটে নিজেকে নিয়ে আসত। কখনও সে কল্পনায় ঈপ্সিতা হাত ধরত মিনারের, চটপটি খাবার পর ওড়না দিয়ে মুখ মুছে দিত, চুলে হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিত।
তুহিনের জন্মদিনটা কিছুটা বিশেষ দিন হয়েই থাকল মিনারের জন্য। ছাত্রর জন্মদিন, শিক্ষকের দাওয়াত ছিল। দাওয়াত ছিল উপর নিচের বাসার আরও অনেকের। ঈপ্সিতাও এসেছিল। শাড়ি পরা ঈপ্সিতাকে সেদিন অন্য রকম সুন্দর লাগছিল। শাড়ি পরার ধরণেও আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল, তবুও। মিনার বার বার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে চাচ্ছিল ঈপ্সিতাকে। তুহিন আর তুলি ব্যাপারটা বুঝে গেলে খারাপ হবে। ওদের শিক্ষক একটা মেয়েকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে ব্যাপারটা ভাল দেখায় না।
ঈপ্সিতাও ঠিক মিনারকে খুঁজে বের করে এসে বলল, কেমন আছ?
- ভাল। তুমি?
- এইতো চলছে।
ঈপ্সিতা ওর পাশের একজন মাঝ বয়সী মহিলার দিকে উদ্দেশ্য করে বলে, মা, এইটাই মিনার। তুহিন আর তুলিকে পড়ায়। ভাল ছাত্র অনেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
এরপর ঈপ্সিতার মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা হয় মিনারের। সেদিন কিছু জানা না গেলেও, পরদিন আবার তুহিন আর তুলিকে পড়াবার সময় ঈপ্সিতার মা এসে বলেন, পড়াতে হবে ঈপ্সিতার ছোট ভাইটাকে। এবার দশম শ্রেণিতে উঠেছে। না করার প্রশ্নই উঠে না। না করেও নি মিনার। রাজী হয়ে যায়। পড়ানও শুরু হয়ে যায়। তুহিন আর তুলিকে পড়াবার পর রাতে পড়ায় ঈপ্সিতার ছোট ভাই ইমনকে। ইচ্ছা করেই বাড়তি সময় নিয়ে পড়াত। পড়ানোর মাঝে বার দুয়েক ঈপ্সিতার দেখা পেত। স্বল্প দেখা পেয়েও ভাল লাগা কাজ করত এই ভেবে যে ঈপ্সিতার বাসায় আছে, চোখের আড়ালে হলেও আশেপাশে ঈপ্সিতা আছে। যে নিঃশ্বাস ফেলছে মিনার, সে নিঃশ্বাস বাতাসে ভেসে ঈপ্সিতার নিঃশ্বাসের সাথে কথা বলছে।
"কী অবস্থা?"
"ভাল। তোমার?"
"ভালই।"
এই পর্যন্তই কথা থেমে থাকত ইমনকে পড়ানোর মাঝে নাস্তা নিয়ে যখন ঈপ্সিতা আসত তখন। ইমনকে পড়ানো শুরু করার পরদিনই মিনার জুতা পাল্টেছে। নতুন টিউশনি, টাকা পয়সা মাস শেষে একটু বাড়তি থাকবে। তাই কিছুটা খরচে কিছু যায় আসবে না। এখন আর লিফটে চড়ার সময়টায় জুতা লুকিয়ে রাখতে হয় না। ব্যাপারখানা বেশ ভাল লাগা দেয় মিনারকে। অস্বস্তি ভাবটাও চলে গেছে। একটা জুতা পাল্টে একটা মানুষের মনে এতোটা পরিবর্তন আসতে পারে তা ভাবনায় ছিল না মিনারের। মাঝে মাঝে ভাবে পোশাক পাল্টে নতুন কিছু, দামী কিছু গায়ে জড়ালে হয়ত আরও পরিবর্তন আসবে। আরও সাহস বাড়বে। আরও ভয় তাড়িয়ে হেসে হেসে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারবে, পড়াতে আসার সময় গেটের কাছের দারোয়ানটাও সালাম দিবে।
সব কিছু ঠিকঠাক চলার দিন গুলোতে হুট করেই কেমন যেন সব বদলে গেল। সেদিন থেকেই, যেদিন লিফটের মাঝে মোবাইল নাম্বার লেখা কাগজটা ঈপ্সিতার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল মিনার।
- কী এটা?
- রাখো, রুমে গিয়ে খুলে দেখো। আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো।
সেদিনের পর দিন দুয়েক, ঈপ্সিতার দেখা পেলেও, এরপর থেকে আর দেখা পায় না মিনার। লিফটের সামনে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেও দেখা হয় না ঈপ্সিতার সাথে। একা একা লিফটে চড়তে কেমন যেন ভাল লাগে না। একটা শূন্যতা ঘুরে ফিরে বুকের ভিতর এপাশ ওপাশ হাহাকার করে। কিছু পাবার তাড়নায় বিমর্ষ হয়ে থুবড়ে পড়ে। খাবার দিতেও আসে না ঈপ্সিতা। মা যখন বলে নাস্তাটা দিয়ে আয় মিনারকে। ঈপ্সিতা বেশ বিরক্তি ফুটিয়ে বলে, আহা আমি ব্যস্ত, তুমি একটু দাও না মা।
ঈপ্সিতা রুম থেকে বের হয় না। মিনারের দেখা হয় না, কথা হয় না। এমন কিছু হবে ভেবেই নিয়েছিল মিনার। তবুও কিছু জিনিস মেনে নেয়াই ভাল, মানা না গেলেও মনকে বলা ভাল, আরে অমন হয়েই থাকে।
সেদিনের দিন দশেক পরের এক দুপুর বেলা ঈপ্সিতার মা মিনারকে ফোন করে বলে, বাবা, আজ তোমার আসতে হবে না। ইমনের স্কুলে প্রোগ্রাম আছে। ইমনকে নিয়ে আমি ওখানেই থাকব। আসতে রাত হবে।
মিনারের সেদিন যাওয়া হয় না ইমনকে পড়াতে। পরক্ষণেই মোবাইলে একটা মেসেজে কেমন যেন করে উঠে বুকের ভিতর।
"দোস্ত, থ্যাংক ইউ। আজ ওদের বাসায় যাব বিকালে। থ্যাংক ইউ সো মাচ।"
মেসেজটার আড়ালে কী লুকিয়ে ছিল জানত মিনার। কিংবা ভেবে নিয়েছিল, কী হতে যাচ্ছে। তুহিন আর তুলিকে পড়ানো শেষে ইমনদের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকে মিনার। কী হচ্ছে ভিতরে বুঝতে চাচ্ছে। বুঝতে পারছে হয়ত। কিংবা মিনার খুবই অবুঝ, পৃথিবীর বোকাতম মানুষদের একজন। যে বোকা মানুষটা অকারণে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কষ্ট পাচ্ছে। হৃদয়ের গভীরের প্রিয় কিছুর হারিয়ে যাওয়া দেখছে, একদম নাগালের বাহিরে ডুবে ডুবে তলিয়ে যাওয়া দেখছে। মিনার মাথা নিচু করে চলে আসে ঈপ্সিতাদের ফ্ল্যাটের সামনে থেকে। এই ফ্ল্যাটের মধ্যে এখন ঈপ্সিতা আর নিলয়। শুধু ঈপ্সিতা আর নিলয়। যার ফোন নাম্বারটা ঈপ্সিতার হাতে তুলে দিয়েছিল মিনার। যার সাথে ফোনে কথা বলার ব্যস্ততায় মিনারকে নাস্তা দিতে আসত না ঈপ্সিতা, যার সাথে দেখা করার কারণে দেরীতে এসে আর লিফটে করে একসাথে যেত না মিনারের সাথে। সেই নিলয় আর ঈপ্সিতা। সবচেয়ে বড় কথা যে নিলয়ের কারণে তুহিন আর তুলির টিউশনিটা পেয়েছিল মিনার। সেখান থেকে ইমনের টিউশনি। যে নিলয়ের কারণে ঢাকার শহরের মত জায়গায় নিজের খরচে চলতে পারে, ছেড়া জুতা পাল্টে নতুন জুতা কিনতে পারে। কলেজ জীবনের এই বন্ধুর জন্য এতটুকু করাটা কিছুই না। আরও অনেক দেনা বাকী নিলয়ের কাছে মিনারের। লিফট করে আস্তে করে নেমে যায় মিনার। আর একবার মনে মনে ধন্যবাদ দেয় নিলয়কে মিনার, ক্ষণিকের জন্য হলেও কিছু ভাল লাগার , হয়ত ভুলে হলেও ভালবাসার একটা মানুষের সাথে পরিচয় হওয়াতে, কাউকে নীরবে হলেও ভালবাসার অনুভবটা পাওয়াতে।
নিচে নেমে যেতেই মিনারের মোবাইলে আর একটা মেসেজ আসে, "মিনার তুমি কি চলে গেছ? বাসায় আসো না একটু প্লিজ। আমি বোধহয় অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি।"
ঈপ্সিতার করা সে মেসেজের রিপ্লাই দেয় না মিনার। লিফটে ৫ নাম্বার বাটনটাতেও চাপ দেয় না। কিছু ভুল, ভুল হয়েই থাক। সব ভুল শুধরাবার দায় মিনারের নয়। নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায় মিনার। বেরিয়ে যাবার সময় গেটের দারোয়ানটা সালাম দেয় না। আশাও করে না মিনার। আশা বেঁচে থাকার যেমন শক্তি, কিছু আশা হতাশা হলে, বেঁচে থাকাও তেমন দুর্বিষহ।
কিছু দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহনীয় করে বেঁচে থাকতেই হয়। কিছু ভালবাসা ওভাবেই ভাল থাকে। কিছু স্মৃতি জড়িয়ে, কখনও না পাওয়ার জেনে, নাগালের বাইরে ভেবে। কেউ কারও হয়, কেউ কারও কখনই নয়। এটাই নিয়ম। এভাবেই জীবন চলে যায়।
Comments
Post a Comment